শাহরিয়ারের বক্তব্যের জবাবে খায়রুজ্জামান বললেন, ‘যেন এই লাশটির দরকার ছিল’
রাজশাহীর বাঘায় আওয়ামী লীগ নেতা আশরাফুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার ‘কোনো কারণ নেই’ বলে দাবি করেছেন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান (লিটন)। হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে আওয়ামী লীগের এই সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য বলেছেন, ‘মনে হচ্ছিল যেন এই লাশটির দরকার ছিল একটি রাজনৈতিক পক্ষের। যেটাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক কোনো প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা যায়।’
দুই পক্ষের সংঘর্ষে বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম নিহত হওয়ার ঘটনায় খায়রুজ্জামানের বিরুদ্ধে মামলা করার ঘোষণা দিয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য শাহরিয়ার আলম। আজ বৃহস্পতিবার আশরাফুল ইসলামের জানাজায় বক্তব্য দেওয়ার সময় মামলায় মদদদাতা হিসেবে রাজশাহী-৩ (পবা-মোহন) আসনের সংসদ সদস্য মো. আসাদুজ্জামান, বাঘা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান লায়েব উদ্দীনকেও আসামি করা হবে বলে মন্তব্য করেন সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।
এর প্রতিক্রিয়ায় আজ বিকেলে সিটি মেয়র খায়রুজ্জামান নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন। সেখানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ রকম একটি নিন্দনীয় ঘটনার সঙ্গে তাঁর জড়িত থাকার কোনো কারণ নেই, যুক্তি নেই। জানাজায় তাঁকে জড়িয়ে, তাঁর নাম-পদবি উল্লেখ করে আরেকজন সংসদ সদস্য আরও কয়েকজনকে জড়িয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি (শাহরিয়ার) যে এ রকম হিংসাপরায়ণ হয়ে এমন একটি মন্তব্য করতে পারেন, এটা তাঁর বোধগম্য নয়। কিছুদিন আগেও তিনি প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। জানাজার মতো একটি পবিত্র জায়গায় তিনি এভাবে মামলা করা হোক, কললিস্ট চেক করা হোক, এ রকম ঘটনা খুব কমই শুনেছেন। তিনি এটা কোন উদ্দেশে করেছেন, এটা তিনিই বলতে পারবেন।
এ এইচ এম খায়রুজ্জামান আরও বলেন, ‘এ ঘটনা খুবই কষ্টকর। আমরা ত্যাগী নেতাকে হারালাম। আমরা সুষ্ঠু তদন্ত চাই, বিচার চাই। মনে হচ্ছিল যেন এই লাশটির দরকার ছিল একটি রাজনৈতিক পক্ষের। যেটাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক কোনো প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা যায়। এ রকম একটা ষড়যন্ত্র বা চক্রান্ত একটা গোষ্ঠীর ছিল বা আছে বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। এ লাইনেও এ বিষয়ে তদন্ত হওয়া দরকার।’
জানাজায় না যাওয়ার বিষয়ে খায়রুজ্জামান বলেন, আশরাফুল ইসলামের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর গতকাল তিনি সন্ধ্যায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়েছেন। সেখানে তাঁর সন্তানকে সান্ত্বনা দিয়েছেন। জানাজায় যাওয়ার তাঁর ইচ্ছা ছিল। আজকে সিটি করপোরেশনের পূর্বনির্ধারিত দুটি গুরুত্বপূর্ণ সভা ছিল। যেগুলো বাতিল করা সম্ভব হয়নি।
এর আগে সংসদ সদস্য শাহরিয়ার আলমের অভিযোগের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে সিটি মেয়র মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাকে যারা পছন্দ করে না, আমার ক্ষতি করতে চায়। প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়, তারা পায়ে পা দিয়ে একটা ঘটনা ঘটিয়ে ষড়যন্ত্রের জাল বুনছে। যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে, একমাত্র তদন্তের মাধ্যমেই বেরিয়ে আসবে প্রকৃত অপরাধী।’ তিনি আরও বলেন, ‘কারা কোন স্বার্থে এ ঘটনা ঘটিয়ে বাবুলকে (আশরাফুল) মৃত্যুর দিকে পতিত করেছে, আমিও তাদের বিচার চাই। তারা পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে সংঘাতের সৃষ্টি করেছে। যারা এটা করেছে, তারাই খুনের মদদদাতা।’
জানাজায় আসার সৎ সাহস নেই কেন—শাহরিয়ার আলমের এমন প্রশ্নের জবাবে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. লায়েব উদ্দীন (লাভলু) বলেছেন, ‘বাঘার মানুষ আমাকে কিছুদিন আগে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেছেন। আমার সৎ সাহস আছে কি না তা বাঘার মানুষ ভালো করেই জানেন। জানাজায় দাঁড়িয়ে লাশ সামনে নিয়ে অপরাজনীতি করছেন শাহরিয়ার আলম। আমরা সেই রাজনীতি করি না।’
লায়েব উদ্দীন আরও বলেন, ‘আমরা জনগণের ও দলিল লেখকদের ন্যায্য দাবির সমর্থন দিয়ে তাঁদেরই আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করেছিলাম। এতেই তাঁদের জ্বালা ধরে যায়। তাঁরা আক্কাছের দুর্নীতি নিয়ে পরের দিনই পাল্টা কর্মসূচি ঘোষণা করলেন এবং সংঘাতে জড়ালেন। শাহরিয়ার আলম আজ লাশ সামনে নিয়ে রাজনীতি করছেন। এই পাল্টা কর্মসূচির মদদদাতা কে, এটা বাঘার সবাই জানেন।’
রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন, ‘মামলা যদি করে তখনই জবাব দেব। এটা তাঁর রাজনৈতিক স্টান্টবাজি। বাবুল আমার হাতে তৈরি কর্মী। বাবুল ত্যাগী নেতা।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি একদম পরিষ্কার, শাহরিয়ার যেটা বলেছেন, তাঁকে ধন্যবাদ। পুলিশ তদন্ত করুক। প্রকৃত খুনিদের মুখোশ উন্মোচিত হোক। তিনি যেহেতু বলেছেন, তিনি প্রমাণ না করতে পারলে তাঁকেও আইনের জায়গাতে আসতে হবে। তিনি দায়িত্বশীল মানুষ। তাঁর জায়গা থেকে তিনি বলেছেন। এ বিষয়টি প্রমাণ না করতে পারলে তাঁকেও আইনের আওতাতে আসতে হবে।’
জানাজার আগে শাহরিয়ার আলমের বক্তব্যের সময় পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অনিল কুমার সরকার। তাঁকে হাত ধরে টেনে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তিনি অভিযোগ করেছেন, তাঁকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে জানাজার স্থান থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। তাঁকে জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নিহত আশরাফুল ইসলামকে শ্রদ্ধা জানাতে নিয়ে যাওয়া ফুলের ডালা দিতে দেওয়া হয়নি। জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও পুঠিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুস সামাদ অপমানজনক কথা বলেন। অনিল কুমার সরকার বলেন, দলের ত্যাগী নেতা মারা গেছেন। সেখান থেকে বের করে দেওয়া শোভনীয় নয়। বিষয়টি তিনি দলকে জানাবেন।
২২ জুন (শনিবার) বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে থানার ওসিসহ অন্তত ৫০ নেতা-কর্মী আহত হন। সংঘর্ষের একপর্যায়ে গুরুতর আহত অবস্থায় উপজেলা চত্বরের ভেতর থেকে আশরাফুল ইসলামকে উদ্ধার করা হয়। তাঁর মাথায় ধারালো অস্ত্রের কোপ ছিল। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল বুধবার বিকেল মারা যান আশরাফুল ইসলাম। রাতেই ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় বাঘায়। পরে আজ জানাজা শেষে দুপুরে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
জানাজায় স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী মো. আবদুল ওয়াদুদ, রাজশাহী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর ইকবাল, মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার, রাজশাহী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আয়েন উদ্দিনসহ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও এলাকাবাসী অংশ নেন।