কাঁদছে বাকশীমূল, কাঁদছে খোদাইধুলি, চলছে মাতম

ট্রেন দুর্ঘটনায় অটোরিশসাচালক সাজু মিয়ার স্ত্রী রাবেয়া বেগমের আহাজারি। মঙ্গলবার কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার বাকশীমূল গ্রামেছবি: প্রথম আলো

মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টা। কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার বাকশীমূল গ্রামে ঢুকতেই দেখা গেল শোকের আবহ। কারও মুখে হাসি নেই। যেন সবার আনন্দ মাটি হয়ে গেছে। কারণ, কিছুক্ষণ আগে ট্রেনের ধাক্কায় গ্রামের পাঁচজন বাসিন্দা প্রাণ হারিয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে মারা গেছেন পাশের খোদাইধুলি গ্রামের আরও দুজন।

গ্রামটির পাশে বাকশীমূল ইউনিয়নের কালিকাপুর এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের একটি অবৈধ ক্রসিং আছে। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ক্রসিংয়ে চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেনের ধাক্কায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চালকসহ সাত যাত্রী নিহত হন। সাতটি পরিবারেই এখন মাতম চলছে। প্রিয়জন হারানোর শোক শুধু নিহত ব্যক্তিদের পরিবারেই সীমাবদ্ধ নেই। মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনা দুই গ্রামের বাসিন্দাদেরও ব্যথিত করেছে।

দুপুর ১২টার দিকে কালিকাপুর এলাকার ওই রেলক্রসিংয়ে যেতেই মানুষের ভিড় চোখে পড়ল। ট্রেনের ধাক্কায় অটোরিকশাটি দুমড়েমুচড়ে গিয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় সাতজনের শরীর। ছয়জনের স্বজনেরা শরীরের বিচ্ছিন্ন অংশ খুঁজে বাড়ি নিয়ে যান। এরপরও রেললাইনে দেখা যায় ক্ষতচিহ্ন। পাশেই চাঁদর দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে বৃদ্ধা হোসনেয়ারা বেগমের (৬৫) মরদেহ। মরদেহটি শনাক্ত করতে কিছুটা সময় লেগেছে। এ জন্য ঘটনার পর প্রায় দুই ঘণ্টা মরদেহটি সেখানে পড়ে ছিল। হোসনেয়ারা বেগম খোদাইধুলি গ্রামের প্রয়াত ফজলু মিয়ার স্ত্রী। ভূমিহীন হওয়ায় গ্রামের সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি ঘরে থাকতেন। মায়ের মরদেহের পাশে বসে আহাজারি করছিলেন ছোট মেয়ে নাসিমা আক্তার। বড় মেয়ে জ্যোৎস্না মারা গেছেন বছর পাঁচেক আগে। জ্যোৎস্নার একমাত্র ছেলে ১২ বছর বয়সী সাইফুল ইসলাম বাড়ি থেকে নানির সঙ্গে বের হয়ে অটোরিকশায় করে পাশের গাজিপুর বাজারে যাচ্ছিল। মায়ের লাশ পেলেও ভাগনের কোনো সন্ধান নেই। এ জন্য নাসিমা আরও দিশেহারা। পাশে থাকা স্বজনেরা তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কিছুতেই তাঁর কান্না থামছে না।

বিলাপ করতে করতে নাসিমা আক্তার বলেন, ‘আমরা দুই বইনরে অনেক কষ্ট কইরা মায়ে বড় করছে। আমার হেই মা-ই আইজকা নাই। এহন আমি কেমনে থাইক্কাম। আমার ভাগিনাডারে পাইতাছি না। আমি কিতা কইরাম জানি না। এতিম পোলাডা বাইচ্চা আছে, নাকি মইরা গেছে, হেইডাও জানি না।’

ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ৭০০ মিটার দূরেই বাকশীমূল গ্রামের অবস্থান। গ্রামে ঢুকতেই প্রথম বাড়িটি ৮০ বছর বয়সী বৃদ্ধ আলী আহমেদের। তিনি ছিলেন চার ছেলে ও চার মেয়ের জনক। স্বজনেরা তাঁর জন্য বিলাপ করছেন। আলী আহমেদের ছেলে সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমার বাবা আমাদের মাথার ওপর ছায়া ছিলেন। আজ আমাদের ছায়াটাই চলে গেল। বাবার বয়স হয়েছে ঠিকই। কিন্তু এভাবে বাবাকে বিদায় দিতে হবে ভাবিনি।’

আরও পড়ুন
ট্রেনের ধাক্কায় নিহতদের স্বজনদের আহাজারি। আজ মঙ্গলবার ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের কালিকাপুর রেলক্রসিং এলাকায়
ছবি: এম সাদেক

গ্রামের একটু ভেতরে উত্তরপাড়ায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চালক সাজু মিয়ার (৩৮) বাড়ি। বাড়িতে দোচালা একটি টিনের ঘর ছাড়া কিছুই নেই। সাজু দুই ছেলেসন্তানের জনক। স্ত্রী রাবেয়া খাতুন (৩৫) সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। স্বামীর লাশের পাশে বসে কান্না করতে করতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। পাশেই নির্বাক দাঁড়িয়ে আছে তাঁদের ছোট ছেলে ১১ বছর বয়সী রিয়াদ হোসেন। যেন শিশুটির বলার কোনো ভাষা নেই।

সাজুর চাচা জালাল মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ভাতিজার পরিবারডা শেষ হইয়া গেল। অটো চালাইয়া যা পাইত, তা দিয়ে কোনোমতে সংসারডা চলত। দুই মাস পরে পোলাডা আরেকটা সন্তানের বাপ হওনের কথা আছিল। এর আগেই সব শেষ হইয়া গেল। পুরা পরিবারডা এহন কেমনে চলব, আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।’

আরও পড়ুন

সাজুদের পাশেই নিহত লুৎফা বেগমের (৫৫) বাড়ি। তিনিও অটোরিকশায় করে বাজারে যাচ্ছিলেন। একটু পরেই তাঁর ফিরে আসার কথা ছিল। কিন্তু ফিরে এল ছিন্নভিন্ন নিথর দেহ। ঘরের সামনে উঠানে তাঁর মরদেহ ঢেকে রাখা। সেখানে বিলাপ করছেন স্বজনেরা। লুৎফার একমাত্র ছেলে সোহেল মিয়া বলেন, ‘আমার মা পরিবারের সবকিছু ছিল। মায়ের এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছি না। আমাদের সব শেষ হয়ে গেল।’

মঙ্গলবারের ওই দুর্ঘটনায় নিহত অন্য তিনজন হলেন বাকশীমূল গ্রামের প্রয়াত আলী আশরাফের স্ত্রী সফরজান বেগম (৬৫), মনির হোসেনের স্ত্রী শাহিনুর আক্তার ওরফে শানু (৩৫) এবং পাশের খোদাইধুলি গ্রামের প্রয়াত আছমত আলীর ছেলে রফিক মিয়া (৬০)। মঙ্গলবার সকালে সাজু মিয়ার ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় করে সকলেই বাকশীমূল গ্রাম থেকে পাশের গাজিপুর বাজারে যাওয়ার সময় ট্রেনের ধাক্কায় নিহত হন।