ভাটার টানে নদীর তীরে ভেসে উঠেছে চেউয়া, চিংড়ি, পাঙাশ, আইর, কাচকি, বেলেসহ বিভিন্ন জাতের মরা মাছ। মাছ ছাড়া সেলেং, ব্যাঙ, কুঁচিয়া, সাপসহ নানা জলজ প্রাণীও মরে ভেসে উঠছে। দূষিত পানি ও মরা মাছের পচা দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে নদীতীর থেকে পাশের লোকালয়েও, চারদিকে উড়ছে মশা-মাছি।
গত সোমবার মেঘনা নদীর চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার এখলাশপুর, ষাটনল, বাবুরবাজার, দশানী, ছটাকী, মোহনপুর, ফরাজীকান্দি, শিকিরচরসহ কয়েকটি এলাকা ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে। স্থানীয় লোকজন বলছেন, পানিদূষণের ফলে কয়েক দিন ধরে মেঘনায় বিভিন্ন জাতের মাছ মরছে। গত কয়েক দিনের মতো গতকালও নদীর তীরে বিভিন্ন জাতের মরা মাছের স্তূপ হয়ে গেছে। মরা মাছের দুর্গন্ধে নাকাল হচ্ছে নদীতীরবর্তী এলাকার বাসিন্দারা, দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছে ৬টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভার প্রায় ২৫ হাজার মানুষ।
স্থানীয় মৎস্য কর্মকর্তারা বলছেন, নদীর পানিতে অ্যামোনিয়ার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় এবং পিএইচ ও অক্সিজেনের হার কমে যাওয়ায় ব্যাপক হারে মাছ মরছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জ জেলার কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য মিশে মেঘনার মিঠাপানিও দূষিত হয়ে উঠেছে।
সম্প্রতি মাছ ও জলজ প্রাণী মারা যাওয়ার খবর পেয়ে নদীর পানির মান পরীক্ষা করছে মতলব উত্তর উপজেলা মৎস কর্মকর্তার কার্যালয়। ফলাফলে দেখা গেছে, মেঘনার পানিতে পিএইচ–এর পরিমাণ কমে এখন ৬ থেকে সাড়ে ৬ পিপিএম–এ দাঁড়িয়েছে। এর স্বাভাবিক পরিমাণ বা নরমাল ভ্যালু সাড়ে ৭ থেকে ৯ পিপিএম। পানিতে অ্যামোনিয়ার স্বাভাবিক পরিমাণ থাকে শূন্য দশমিক ১ পিপিএম। মেঘনার পানিতে সেটি বেড়ে এখন শূন্য দশমিক ২ পিপিএম বা ততোধিক। পানিতে অক্সিজেনের স্বাভাবিক পরিমাণ থাকে ৫ থেকে সাড়ে ৫ পিপিএম। অতিরিক্ত দূষণের ফলে মেঘনার পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ১ থেকে দেড় পিপিএম–এ। এ কারণে ব্যাপক হারে মাছ মরে যাচ্ছে।
সরেজমিনে মতলব উত্তর উপজেলার মেঘনাতীরবর্তী এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, চারদিকে মরা মাছ ও জলজ প্রাণীর দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। কারখানার বর্জ্য মিশে এসব এলাকায় নদীর পানি ঘোলাটে ও কালচে হয়ে গেছে। ওই দূষিত পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। স্থানীয় লোকজন নদীর পানিতে গোসল ও ধোয়া–মোছার কাজ করতে পারছেন না।
মেঘনাতীরবর্তী বাবুরবাজার এলাকার বাসিন্দা ফুলচান বর্মণ এবং এখলাশপুর এলাকার জামাল হোসেন বলেন, কয়েক দিন ধরে জোয়ারের সময় মেঘনায় ব্যাপক হারে মরা মাছ ভেসে উঠছে। ভাটার সময় ওই মরা মাছ তীরে এসে জমা হচ্ছে। মেঘনার পানিও দূষিত হয়ে ঘোলাটে ও কালো রংয়ের হয়ে গেছে। একদিকে দূষিত পানির গন্ধ, অন্যদিকে মরা মাছের গন্ধে তাঁরা নাকাল। ষাটনল, মোহনপুর, এখলাশপুর, কলাকান্দা, ফরাজীকান্দি ও জহিরাবাদ ইউনিয়নের ১৫টি গ্রাম এবং ছেংগারচর, পৌরসভার শিকিরচরসহ আরও কয়েকটি এলাকার অন্তত ২৫ হাজার মানুষ এই দূষণের শিকার হচ্ছে। স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন তাঁরা।
মোহনপুর এলাকার আলী হোসেন বলেন, মেঘনার পানি তীব্রভাবে দূষিত হওয়ায় ওই পানিতে গোসল করতে পারছেন না তাঁরা। গৃহস্থালির প্রয়োজনেও ব্যবহার করছেন না। প্রতিবছর এ সময় মেঘনার হালকা সবুজ পানি দূষিত হয়ে রং বদলে কালো ও ঘোলাটে হচ্ছে। এ সময় মাছও মরে ভেসে উঠছে। তবে এবার একটু বেশি মাছ মরছে।
ষাটনল এলাকার অপু চন্দ্র বর্মণ বলেন, মেঘনার পচা পানি পান করে এবং তীরে জমে থাকা মরা মাছের দুর্গন্ধে তাঁর এলাকার লোকজন অসুস্থ হচ্ছে। আক্রান্ত হচ্ছে ডায়রিয়া, আমাশয়সহ নানা রোগে। বিশেষ করে দুর্গন্ধে শিশুরা প্রায়ই বমি করছে। মাথাও ঝিম ঝিম করছে তাদের। এ সমস্যার দ্রুত সমাধান হওয়া দরকার।
স্থানীয় মৎস্য বিভাগ জানায়, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জের কলকারখানার বর্জ্য বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যায় মিশলেও ওই নদীতে অতিরিক্ত যান চলাচল ও পানিদূষণের কারণে তেমন হারে মাছ থাকে না। মেঘনার মিঠাপানিতে প্রচুর মাছ থাকে। বিশেষ করে দেশি জাতের মাছের বিচরণ বেশি এখানে। শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গার বর্জ্যমেশানো দূষিত পানি মেঘনার পানিতে মিশে ওই পানিকে অধিক মাত্রায় দূষিত করছে। এতে মেঘনার পানিতে অক্সিজেন ও পিএইচ–এর পরিমাণ অনেক কমেছে। বেড়েছে অ্যামোনিয়ার মাত্রা।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিজয় কুমার দাস বলেন, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জ এলাকার কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গা হয়ে জোয়ারের স্রোতে মেঘনার মিঠাপানিতে মিশে যাচ্ছে। এতে মেঘনার পানি দূষিত হচ্ছে। দূষণের ফলে পানিতে অ্যামোনিয়ার পরিমাণ বেড়েছে এবং পিএইচ ও অক্সিজেনের পরিমাণ কমেছে। এতে নদীর মাছ মরে যাচ্ছে বলে ধারণা করছেন তাঁরা। সার্বিক পরিস্থিতি জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়, জেলা মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ও মৎস্য অধিদপ্তরে জানানো হয়েছে।
চাঁদপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, তিনি মেঘনাতীরবর্তী এলাকাগুলো পরিদর্শন করেছেন। আপাতত এর বেশি কিছু বলতে পারবেন না।
মতলব সরকারি কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষক অশোক কুমার রায় বলেন, দূষণের ফলে যে হারে মেঘনার পানিতে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী মারা যাচ্ছে, তা উদ্বেগজনক। মরা মাছ নদীর তীরে জমে থাকায় নদীর আশপাশের এলাকায় যেভাবে তীব্র দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, তাতে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে হাজারো মানুষ। নদীদূষণ ও পরিবেশদূষণ বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।