ডাক্তারদের ওপর এত রাগ কেন

সাম্প্রতিক সময়ে দুটি ঘটনার কথা উল্লেখ করি। গত ১৩ এপ্রিল চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত এক শিশুর মৃত্যুর পর শিশুটির আত্মীয়স্বজনের হামলার শিকার হয়েছেন ওই হাসপাতালের একজন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ। এমনভাবে মারধর করা হয়েছে যে তাত্ক্ষণিক হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ভর্তি হতে হয়েছে তাঁকে। দ্বিতীয় ঘটনাটি শহরের অদূরে পটিয়া উপজেলায়।

সেখানে গত ১০ এপ্রিল মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত আওয়ামী লীগের এক নেতাকে চিকিত্সাসেবা দিতে বিলম্ব হওয়ার অভিযোগে কর্তব্যরত চিকিত্সকের ওপর হামলে পড়েন তাঁর বন্ধু-সমর্থকেরা। কিলঘুষিতে মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়েছেন চিকিত্সক।

মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে এ রকম দুটি সহিংস ঘটনায় চিকিত্সক সমাজ স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত। চিকিত্সকদের একটি সংগঠন বলছে, বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকেই এ রকম ঘটনা বাড়ছে। অন্য একটি সংগঠন মানববন্ধন করেছে এবং নির্দিষ্ট সময়ের জন্য চিকিত্সাসেবা বন্ধ রেখে তার প্রতিবাদ জানিয়েছে।

এ দুটি ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রথমটি ঘটেছে চিকিত্সকের প্রতি একধরনের আস্থাহীনতা থেকে। দ্বিতীয় ঘটনাটিতে আস্থা বা বিশ্বাসের ঘাটতি তো আছেই, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ক্ষমতার দাপট।

রোগে-দুর্ভোগে মানুষের আশ্রয়স্থল হাসপাতাল আর ভরসা চিকিত্সক। সেই চিকিত্সকদের ওপর যদি রোগীর মনে আস্থা ও বিশ্বাসের অভাব ঘটে, তাহলে দাঁড়ানোর জায়গা কোথায়? অন্যদিকে সেবা দিতে গিয়ে একজন চিকিত্সক যদি নিজে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন, তাহলে তাঁর পক্ষে কি নির্ভয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন সম্ভব? এ প্রশ্ন এখন সমাজের সর্বত্র আলোচিত।

চিকিত্সক ও রোগীর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস ও বোঝাপড়া গড়ে তোলার গুরুত্ব নিয়ে নিঃসন্দেহ সবাই। কিন্তু সেই সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে কীভাবে?

প্রয়োজনের সময় চিকিৎসককে ঈশ্বরের পরের স্থানে বসিয়ে দেন, আবার সেই রোগীই প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে তাঁকে আড়ালে গালাগাল করতে কসুর করেন না বলে দুঃখ প্রকাশ করেছেন একজন চিকিত্সক। চট্টগ্রামের একটি রেস্তোরাঁয় আয়োজিত এক সেমিনারে এই খেদোক্তি করেন ওই চিকিত্সক।

সম্প্রতি খুবই সময়োপযোগী সেমিনারটির আয়োজন করেছে চিকিত্সকদের সংগঠন ‘ডক্টরস ফর হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’। সেমিনারের মূল প্রতিপাদ্য ছিল ‘মেডিকেল এথিকস অ্যান্ড ডক্টর-পেশেন্ট রিলেশনশিপ’। বিষয়টি নিয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ডা. নন্দন কুমার মজুমদার। এ সময়ের অত্যন্ত উদ্বেগ ও উত্কণ্ঠার একটি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করায় সেমিনারটি হয়ে উঠেছিল প্রাণবন্ত। উন্মুক্ত আলোচনা পর্বে চিকিত্সক, সাংবাদিক, শিক্ষক, আইনজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ ডাক্তার ও রোগীর সম্পর্কের নানা মাত্রা নিয়ে খোলামেলা মত প্রকাশ করেছেন।

রোগীর জানতে চাওয়ার অধিকার আছে। তাঁকে রোগ, চিকিত্সাপদ্ধতি এমনকি চিকিত্সার ব্যয় সম্পর্কে ধারণা দেওয়া চিকিত্সকের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে বলে ডা. নন্দন কুমার মজুমদার উল্লেখ করেছেন। চিকিত্সাবিজ্ঞানের ছাত্ররা এই নীতি–নৈতিকতা সম্পর্কে ধারণা লাভ করলে জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সহজ হবে। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রাখতে হবে। রোগীর ক্ষেত্রে উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ করা যাবে না। বয়স, জাত-ধর্ম ও লিঙ্গনির্বিশেষে সবার প্রতি সমান আচরণ করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, রোগী বা তাঁর স্বজনদের সত্য কথা বলতে হবে, যাতে তাঁদের মনে কোনো বিভ্রান্তির সৃষ্টি না হয়। পাশাপাশি রোগী ও তাঁর স্বজনদেরও সচেতন হতে হবে বলে মত প্রকাশ করেছেন ডা. মজুমদার।

একজন চিকিত্সক এখনকার রোগীদের প্রবণতা তুলে ধরে বলেন, তাঁরা ইউটিউবে রোগ সম্পর্কে ধারণা নেন, তারপর চিকিত্সককে সেই পদ্ধতিতে চিকিত্সা করতে বলেন। এমনকি প্রয়োজন না থাকলেও রোগীকে অপারেশন করার জন্য চাপ দিতে থাকেন। এভাবে ভুল–বোঝাবুঝি হয়। একটি প্যারাসিটামল ট্যাবলেট দিলেও এখনকার গুগল-ইউটিউব দেখে অভ্যস্ত রোগীরা চিকিত্সককে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে জ্ঞান দিতে আসেন বলে হতাশা প্রকাশ করেন এই চিকিত্সক।

সচেতনতা তৈরিতে গণমাধ্যমেরও ভূমিকা আছে বলে উল্লেখ করে আরেক চিকিত্সক ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, সাংবাদিকদের মধ্যে যাঁরা চিকিত্সার বিষয়ে রিপোর্ট করেন, তাঁদের মধ্যে এ বিষয়ে ন্যূনতম জ্ঞান নেই। ‘ভুল চিকিত্সায় রোগীর মৃত্যু’ এ ধরনের গড়পড়তা সংবাদের কারণে অনেক সময় ভুল–বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। চিকিত্সকেরা ভালো কিছু করলে তা সংবাদপত্রে উল্লেখ করা হয় না বলে তাঁর দাবি।

আবার উল্টো দিকের বক্তব্য আছে, প্রতিদিন বিশ্বের শত শত বিমানবন্দর থেকে হাজার হাজার বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণ করে, কিন্তু সেটা সংবাদপত্রে স্থান পায় না। কোনো বিমান দুর্ঘটনায় পড়লে তখনই তা সংবাদপত্রে স্থান পায়। সুচিকিত্সা পেয়ে রোগী নিরাময় হলে তা নিয়ে খবর হয় না। ভুল চিকিত্সায় মৃত্যুর খবরই প্রচারিত হয়। তবে এখন ‘ভুল চিকিত্সায় মৃত্যু’ না লিখে ‘ভুল চিকিত্সার অভিযোগে মৃত্যু’ শিরোনামটি সচরাচর লেখা হয়। হাসপাতালে হামলা বা চিকিত্সকের ওপর দুর্বৃত্তদের হামলার সংবাদও প্রকাশ করেন সাংবাদিকেরা।

আমাদের দেশের মানুষের স্বাস্থ্যসচেতনতার অভাব নিয়ে বিভিন্ন বক্তা কথা বলেছেন। নিজেরা নির্দিষ্ট সময়ান্তে শরীরের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করান না, অথচ চিকিৎসক কোনো পরীক্ষার পরামর্শ দিলে ধরে নেন, কমিশন পাওয়ার জন্য তিনি পরীক্ষা করাতে বলেছেন। এই অনাস্থা ও অবিশ্বাসের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তবে চিকিত্সকেরা যে স্বাস্থ্য পরীক্ষা বাবদ ক্লিনিকে প্রদেয় টাকার একটি অংশের ভাগ পান, এ কথাও সত্য! এ প্রসঙ্গে একজন চিকিত্সক অবশ্য খুবই যুক্তিপূর্ণ প্রস্তাব দিয়েছেন। তাঁর মতে, শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সরকারই ফি নির্ধারণ করে দিতে পারে। এটা কঠিন কিছু নয়। অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত হাসপাতালে তা সামান্য বেশি হতে পারে। মোটকথা সরকার ফি নির্ধারণ করে দিলে চিকিত্সকদের কমিশন দেওয়ার প্রতিযোগিতা থেকে হাসপাতাল বা ক্লিনিকগুলো নিরস্ত হবে।

আমাদের স্বাস্থ্য খাতে বাজেটের স্বল্পতা, সরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগীর সংখ্যার তুলনায় শয্যা, জনবল, অর্থবল, প্রয়োজনীয় চিকিত্সার সরঞ্জাম ইত্যাদি অভাবের কথা বারবার উঠে এসেছে। দুর্ভাগ্যক্রমে এসব অভাব ও অব্যবস্থাপনার দায় নিতে হয় চিকিত্সকদের। একজন আইনজীবী বলেন, আমাদের সংবিধানে চিকিত্সাকে ‘চাহিদা’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যত দিন চিকিত্সাকে ‘অধিকারের’ পর্যায়ে উন্নীত করা হবে না, তত দিন অবস্থার পরিবর্তন হবে না।

হাসপাতালে ভাঙচুর বা চিকিত্সকদের হামলার ঘটনা আমাদের সমাজের সার্বিক অবক্ষয়ের একটি চিত্র বলে মত প্রকাশ করেছেন বক্তারা। এ ব্যাপারে দোষীদের শনাক্ত করা ও শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি করেছেন প্রায় সবাই।

রোগীর মৃত্যু হলেই ডাক্তারের অবহেলা বা অপচিকিত্সা বলে ধারণা করার পেছনে কারণ কী, তা চিহ্নিত করতে হবে। এখানেই রোগীর আত্মীয়স্বজনকে তাঁর অবস্থা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা দেওয়ার বিষয়টি আসে। জীবন রক্ষার সর্বশেষ ব্যবস্থা হিসেবে যে ইনজেকশন দেওয়া হয়, সেটির পর কোনো রোগীর মৃত্যু হলেই যেন ধারণা না হয়, ইনজেকশনের কারণে মৃত্যু হয়েছে। তাই আগেভাগেই ধারণা দিতে হবে।

চিকিত্সা পেশা মানুষের জীবন-মরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ফলে চিকিত্সকদের অনেক ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়। সমাজে চিকিত্সকদের মর্যাদা যে কমেনি তার বড় প্রমাণ, এখনো নিজের সন্তানকে চিকিত্সক পেশায় দেখতে চান অভিভাবকেরা, এখনো মেধাবী শিক্ষার্থীদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য মেডিকেল কলেজ। এসব কথা উঠে এসেছে সেমিনারের আলোচনায়।

মূল প্রবন্ধে ডা. মজুমদার একটি অসাধারণ কথা বলেছেন, চিকিত্সক ও রোগীর সম্পর্ক হোক মাছ ও জলের মতো, তা যেন কিছুতেই মাছ ও জেলের সম্পর্কের মতো না হয়। কথাটি অনুধাবন করতে পারলে অনেক সম্যার সমাধান হয়ে যায়।