শীতের মিঠে রোদে ঘুরে আসুন সন্দ্বীপ

সন্দ্বীপের পশ্চিম উপকূলের রহমতপুরের খোলা প্রাঙ্গণে তাঁবুতে রাত যাপন করেন অনেক পর্যটক। সম্প্রতি তোলাপ্রথম আলো

শীতের মিঠে রোদ পড়েছে সারি সারি নারকেলগাছের মাথায়। তার পাশে বিস্তীর্ণ মাঠের মসৃণ ঘাসের কার্পেট এসে মিশেছে সাগরের বালুচরে। নিরিবিলি গ্রামের মেঠো পথের দুই ধারে ধানের খেত। খেতের আলে লাগানো খেজুরের গাছে বসানো হাঁড়ি। সেখান থেকেই ছড়িয়ে পড়ছে রসের ঘ্রাণ। একটু গেলেই গৃহস্থবাড়ির পুকুরে হাঁসের ঝাঁকের ঝুপঝাপ নেমে যাওয়ার দৃশ্য—এমন মনভোলানো পরিবেশ চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ ছাড়া আর কোথায় আছে।

যারা সাগর, নদী, চর, মহিষের বাথানের গল্প শুনেছেন, ভালোবাসেন গ্রামীণ পরিবেশ আর অকৃত্রিম আতিথ্য—সন্দ্বীপ তাঁদের জন্য বেড়ানোর আদর্শ জায়গা। এখানে এলে রসে ডুবিয়ে পিঠাপুলির স্বাদ যেমন নেওয়া যাবে, তেমনি পুকুর-নদীর তাজা মাছ, হাঁসের মাংস, মহিষের দইয়ে রসনা তৃপ্ত করার সুযোগ মিলবে। সন্দ্বীপ যে এসবেরই জন্য বিখ্যাত। অপরূপ প্রকৃতি যেমন এই দ্বীপের শোভা, তেমনি এখানকার অকৃত্রিম ও অতিথিপরায়ণ মানুষজনও আপনার মন ভোলাবে।

যা যা দেখার আছে

প্রথমবার এলে সন্দ্বীপের রিং বেড়িবাঁধ ধরে ঘুরে আসতে পারেন চারপাশ। দক্ষিণের চৌকাতলী থেকে উত্তরের বটগাছতলা, ইলিশের ঘাট। পশ্চিম উপকূলের রহমতপুর সৈকতে সবুজ ঘাসের বিস্তার আর দিগন্তে মিশে যাওয়া প্রান্তর মুগ্ধতা ছড়াবে মনে। কয়েক বছর ধরে এখানে এসে তাঁবু খাটাতে দেখা গেছে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পর্যটকদের। প্রতিদিন বিকেলে এখানে দল বেঁধে ঘুরতে আসেন স্থানীয় বাসিন্দারা। সেখান থেকে চাইলে যাওয়া যায় নতুন জেগে ওঠা চরে। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত সাগরে বিলীন হওয়া সন্দ্বীপের সাতটি ইউনিয়নের ভূমি নতুন করে জেগে উঠেছে। দিগন্তের চিবুক স্পর্শ করা এই সমতল ভূমি পরিচিত সবুজচর হিসেবে। সেখানে ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে নতুন নতুন জনপদ। ধানের খেত, গোলাঘর, বসতঘর, পুকুর আর গোপাট—সব মিলিয়ে নিখুঁত গ্রাম। হেঁটে বা মোটরবাইকে চেপে চলে যেতে পারেন সবুজচরের সঙ্গে লাগোয়া কম বয়সী চরেও। ঘুরে আসতে পারেন মহিষ বাথানে। ভালো লাগলে রাতও কাটিয়ে আসতে পারেন।

সন্দ্বীপের কেন্দ্রভাগে অবস্থিত বে ভিউ গার্ডেনস পার্ক
সম্প্রতি তোলা

মর্জিমতো সময় কাটাতে পারেন আধুনিক আয়োজনেও। দ্বীপের কেন্দ্রভাগে আছে বে ভিউ গার্ডেনস পার্ক। সেখানে বিশালাকৃতির একাধিক দিঘির পাড়ে নারকেলগাছের সারি যে কারও মন ভোলাবে। উপাদেয় খাবারের সমাহার নিয়ে প্রবেশমুখেই আছে সমৃদ্ধ রেস্তোরাঁ। সপ্রাণ আড্ডা অথবা একান্তে সময় কাটানোর জন্য আছে বিস্তৃত পরিসর। রাতযাপনের আয়োজন না থাকলেও বিকেল বা সন্ধ্যাবেলাটুকু রাঙিয়ে নিতে এই পার্ক হতে পারে আদর্শ।

কেউ চাইলে উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের পথিকৃৎ কমরেড মুজফ্ফর আহমদ, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা বেলাল মোহাম্মদ অথবা জমিদার পুলিন গুহের শৈশবের বাড়ি দেখে আসতে পারেন। একসময় উসমানীয় সাম্রাজ্যে কাঠের তৈরি যুদ্ধজাহাজ রপ্তানি করত সন্দ্বীপের কারিগরেরা। সেই ঘাটের দেখা এখন আর মিলবে না। তবে সারিকাইতের বাংলাবাজার ঘাট আর গাছতলী ঘাটে এই পেশার কিছু মানুষের দেখা মিলতে পারে এখনো। মহিষের দুধ বা দই, খেজুরের রস, বিনয় সাহার বিখ্যাত মিষ্টান্ন, শতবর্ষী রাজাশাইলের ভাত আর বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক মাছ পাতে তুলে নিতে পারেন চাইলে।

রাতে কোথায় থাকবেন

দ্বীপের একেবারে উত্তর প্রান্তে ১০ একর জায়গাজুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে ‘ট্রাভেলি ইকো ভিলেজ’ নামের একটি রিসোর্ট। স্থানীয় উদ্ভিদের পাশাপাশি বিপন্ন প্রজাতির বৃক্ষরাজির দেখা মিলবে এখানে। প্রকৃতির সান্নিধ্য পেতে আর নৈসর্গিক নিস্তব্ধতায় ডুব দিতে এটি বেছে নিতে পারেন। সন্দ্বীপের কৃষিনির্ভর গ্রামীণ জনজীবনকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ মিলবে এখানে। রাতযাপনে নানা আয়োজন আছে এখানে। থাকার জন্য খরচ পড়বে এখানে তিনবেলা খাবার, থাকাসহ জনপ্রতি ৮০০ টাকার মতো।

সন্তোষপুরের ট্রাভেলি ইকো ভিলেজ ছাড়াও রাতে থাকতে প্রচলিত ধারার একগুচ্ছ হোটেল আছে সন্দ্বীপ সদরের মূল রাস্তার দুই পাশে। সন্দ্বীপ টাওয়ার, জামান গেস্টহাউস, আল ফয়সাল গেস্টহাউস সেসবের অন্যতম। এসব হোটেলে নন–এসি ডাবল রুমের ভাড়া ৮০০ থেকে ১০০০ এবং এসি ২০০০ থেকে ৩০০০ টাকা।

সন্দ্বীপের উত্তর প্রান্তের ট্রাভেলি ইকো ভিলেজ
সম্প্রতি তোলা। প্রথম আলো

কীভাবে যাবেন

দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ডের কুমিরায় নেমে সোজা ঘাটে চলে যাবেন। কুমিরা থেকে ঘাটের ভাড়া অটোরিকশায় জনপ্রতি ১৫ টাকা। চট্টগ্রাম শহরের হালিশহর এ ব্লক, নয়াবাজার বিশ্বরোড এবং সিটি গেট থেকে জনপ্রতি ২০০ টাকায় মিলবে কুমিরা ঘাটের প্রাইভেট কার। ঘাটের কাউন্টার থেকে টিকিট নিয়ে উঠে পড়বেন স্পিডবোটে। ভাড়া ২৫০ টাকা। ১৫ মিনিটের জলযাত্রা শেষে সন্দ্বীপে পা রাখবেন। এবার পূর্বনির্ধারিত গন্তব্যে যেতে বাহনের সঙ্গে ভাড়া ঠিকঠাক করে রওনা দেওয়ার পালা। দূরত্ব অনুয়ায়ী ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা ভাড়া নেবে অটো বা সিএনজি। বিচ্ছিন্ন দ্বীপ বলেই এখানে সব ক্ষেত্রে খরচ কিছুটা বেশি। নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত সন্দ্বীপে বেড়িয়ে আসার উত্তম সময়।