মুড়িকাটা পেঁয়াজের দামে হতাশ রাজশাহীর কৃষক
রাজশাহীতে নতুন মৌসুমের পেঁয়াজ বাজারে উঠতে শুরু করেছে। তবে পেঁয়াজের দাম কম হওয়ায় হতাশ কৃষকেরা। তাঁরা বলছেন, বেশি দামে পেঁয়াজ কন্দ কিনে লাগানোর কারণে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। কিন্তু বাজারে পেঁয়াজের দাম কম; বর্তমান দামে উৎপাদন খরচের অর্ধেকও উঠছে না। সামনে সরবরাহ বাড়লে পেঁয়াজের দাম আরও কমবে।
পেঁয়াজের কন্দ থেকে মুড়িকাটা পেঁয়াজ হয়। রাজশাহীতে এখন এই পেঁয়াজ উঠতে শুরু করেছে। বর্তমানে মোকামে এই পেঁয়াজ ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে।
মঙ্গলবার সকালে বাঘা উপজেলার পাকুড়িয়া ইউনিয়নের কলিগ্রাম মাঠে গিয়ে দেখা যায়, কৃষকেরা মুড়িকাটা পেঁয়াজ তুলছেন। মাঠেই তাঁরা এই পেঁয়াজ বাছাই করে রোদে শুকিয়ে নিচ্ছেন। নারী শ্রমিকেরা পেঁয়াজ তুলে এক জায়গায় জড়ো করছেন। মাঠেই পাওয়া গেল পাকুড়িয়া গ্রামের কৃষক শফিকুল ইসলাম, ফজলুল হক, সাবাজুল ইসলামসহ অনেককে।
কৃষকেরা বলছেন, এবার রোপণ মৌসুমে বীজের দাম ছিল বেশি। ৭ থেকে ১২ হাজার টাকা মণ দরে পেঁয়াজের কন্দ কিনে রোপণ করতে হয়েছে। গড়ে এক বিঘায় ১০ মণ করে বীজ লেগেছে। শুধু বীজের খরচই হয়েছে ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত। জমির ইজারা, সার কীটনাশক এবং শ্রমিকের মজুরি মিটিয়ে আরও ৪০ হাজার টাকার খরচ হয়েছে। জমি থেকে পেঁয়াজ তোলা পর্যন্ত আরও খরচ হয়েছে। গড়ে এক বিঘা জমির জন্য কৃষককে মোট ব্যয় করতে হয়েছে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত।
এবার বৃষ্টি হওয়ার কারণে পেঁয়াজের জমিতে জো ধরতে দেরি হয়েছে। এক বিঘা জমিতে ৭০ মণ পর্যন্ত পেঁয়াজ হয়। এবার আর সেটা হচ্ছে না। এবার ৫০ থেকে ৬০ মণের বেশি পেঁয়াজ হচ্ছে না। এখন মোকামে এই পেঁয়াজ ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে।
এখন ১ হাজার ৪০০ টাকা মণ দরে বিক্রি করতে পারলে এবং ৬০ মণ হারে পেঁয়াজের উৎপাদন হলে প্রায় ৮৪ হাজার টাকা কৃষকের ঘরে আসছে। আরও ৩৬ হাজার টাকা লোকসান হচ্ছে। আর বিঘাপ্রতি ৫০ মণ হারে পেঁয়াজ উৎপাদন হলে কৃষকের লোকসান হচ্ছে ৬০ হাজার টাকা।
কৃষকদের কাছ থেকে মুঠোফোন নিয়ে কথা হয় ঢাকার শ্যামবাজারের মেসার্স আলী ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী শামসুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বললেন, সারা দেশ থেকে মুড়িকাটা পেঁয়াজ আসছে। এরই মধ্যে ভারতীয় পেঁয়াজে বাজার সয়লাব। মুড়িকাটা পেঁয়াজ ৩৫–৩৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। সবচেয়ে ভালো ফলন হলে বিঘাপ্রতি ৫০ থেকে ৬০ মণ পেঁয়াজ হয়েছে। অনেকের ৩০ মণও হয়েছে। এই দামে পেঁয়াজ বিক্রির মানে কৃষকের উৎপাদন খরচের অর্ধেকের বেশি টাকাই উঠবে না। দাম যদি এই রকমই থাকে, আগামী বছর ভয়ে কৃষক আর পেঁয়াজ করতে যাবেন না।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহীতে মুড়িকাটা পেঁয়াজের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৭ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে। এর বিপরীতে চাষ হয়েছে ১১ হাজার ২২৫ সেক্টর জমিতে। সবে পেঁয়াজ উঠতে শুরু করেছে।
রাজশাহীর বাঘা উপজেলার পলাশী ফতেপুর গ্রামের কৃষক আসাদুল ইসলাম এবার ৭০ বিঘা জমিতে মুড়িকাটা পেঁয়াজ চাষ করেছেন। তিনি বলেন, ইতিমধ্যেই এক বিঘা জমির পেঁয়াজ তুলেছেন। বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখছেন, এ পেঁয়াজের দাম ৩৮ থেকে ৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ঢাকায় বাজার আরও খারাপ। তাঁরা ঢাকায় সাধারণত ঢাকার শ্যামবাজার, গাজীপুর, নওগাঁ ও বগুড়ায় পেঁয়াজ দেন। এবার পেঁয়াজ নওগাঁয় পাঠাবেন, সেখানে আজ ৩৫ টাকা কেজি; অর্থাৎ ১ হাজার ৪০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে। এই দরে আজ বিক্রি করলে অর্ধেক টাকা লোকসান হবে। উৎপাদন খরচ উঠবে না। সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন, এই সময়ে এলসির পেঁয়াজ আসছে। উৎপাদন মৌসুমে আমদানি বন্ধ না করলে কৃষক মাঠে মারা যাবেন। কৃষককে বাঁচাতে হলে উৎপাদন মৌসুমে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ করতে হবে।
বাঘা উপজেলার পাকুড়িয়া গ্রামের কৃষক ফজলুল হক ২০ বিঘা জমিতে এবার মুড়িকাটা পেঁয়াজ চাষ করেছেন। তিনি বলেন, ১ হাজার ২০০ টাকার বেশি তিনি পেঁয়াজ বিক্রি করতে পারছেন না। এখানে তাঁর ৬০ হাজার টাকাই লোকসান হচ্ছে। ১ বিঘা জমির পেঁয়াজ তুলে প্রথম দিনে ৫২ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে পেরেছেন। তারপর আর ওই দরে বিক্রি করতে পারছেন না।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক উম্মে সালমা বুধবার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘পেঁয়াজ আমদানি করার বিষয়টি একটি জাতীয় ইস্যু। আমি রাজশাহী থেকে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারি না।’