শত বছরের ‘বাঁশের হাট’ ঘিরে কতশত কথা
নিঃশব্দ-নীরবে বইছে কুশিয়ারা নদী। এখন শুষ্ক মৌসুম, নদীর অনেক নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ধীরস্রোতের জল। সেই নদীর পারেই শত বছর আগে গড়ে উঠেছিল একটি গ্রামীণ হাট, কালারবাজার-নলুয়ারমুখ। তবে সবার কাছে কালারবাজার নামেই হাটটির পরিচিতি বেশি।
রকমারি পণ্য থাকলেও প্রায় সব হাটেই যেমন কমবেশি কিছু ব্যতিক্রম, বিশেষ কিছু পণ্যের পরিচিতি থাকে; কালারবাজার-নলুয়ারমুখ হাটেও আছে তেমনই একটি পণ্য—বাঁশ। সেই যে হাটটির সূচনা সময় থেকে এখানে বাঁশ বিক্রি শুরু হয়েছিল, সেই ধারা এখনো টিকে আছে। মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার উত্তরভাগ ইউনিয়নের কুশিয়ারা নদীর পারে গড়ে ওঠা এই হাট এখনো বাঁশের জন্য আলাদা পরিচিতি নিয়ে চলছে। কালারবাজার-নলুয়ারমুখ শুধু মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলাতেই নয়, বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলেরও একটি পরিচিত ‘বাঁশের হাট’।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরের দিকে কাউয়াদীঘি হাওর ঘিরে তৈরি চাঁদনীঘাট-হলদিগুল সড়ক দিয়ে উত্তরভাগের কালারবাজার-নলুয়ারমুখ বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, নদী ও হাওরপারের বাজারটি তখন স্থানীয় মানুষের বিক্ষিপ্ত আনাগোনাতে অনেকটাই সরগরম হয়ে আছে। বিভিন্ন দিক থেকে মানুষ আসছেন, কেনাকাটা করছেন। হাতে ব্যাগ ঝুলিয়ে আবার বাড়ি ফিরছেন। কোথাও কোনো দোকানের বারান্দায়, গাছতলায় কেউ কেউ বসে জটলা করে সময় পার করছেন। এ রকমই অবসর কাটানো কয়েকজনের ভিড়ে কথার ফাঁকে একজন জানালেন, অনেক কিছু থাকলেও কালারবাজার-নলুয়ারমুখ বাজারটি বাঁশের জন্য সবার কাছে পরিচিত। দূরদূরান্তের মানুষ এই বাজারে বাঁশ কিনতে আসেন। আর এই বাজারে বাঁশ বিক্রির ঐতিহ্য শত বছরের পুরোনো।
তাঁদের কথামতো হাটের পশ্চিম দিকে গিয়ে এই বাঁশের দেখা পাওয়া যায়। চাঁদনীঘাট-হলদিগুল সড়কের উত্তর পাশে নিচু জমিতে এই বাঁশের হাটটি। এখানে থরে থরে লম্বা, মাঝারি ও ছোট দৈর্ঘ্যরে অনেক বাঁশ বিছিয়ে রাখা হয়েছে। কেউ আসছেন, প্রয়োজনীয় বাঁশ পছন্দ করছেন। দরদামে পোষালে বাঁশ আলাদা করে রাখছেন।
হাটেই দেখা বাঁশ ব্যবসায়ী মো. বাছিত মিয়ার (৫০) সঙ্গে। এই বাঁশের হাটের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ৩৫ বছরের মতো। তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা থাকি (থেকে) বাঁশর ব্যবসা করিয়ার (করতেছি)। ৩৫ বছরর কম অইতো নায় (হবে না)। বিভিন্ন গ্রাম থাকি বাঁশ কিনি। বহু দূর থাকি বাঁশ কিনাত মানুষ আইন (কিনতে মানুষ আসেন)। সিলেট-মৌলভীবাজারে এত পুরান (পুরোনো) বড় বাঁশর বাজার আর আছে কি না, আমার জানা নাই।’
বাঁশ ব্যবসায়ী ও স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাটটি গড়ে উঠেছে ১০০ বছরের বেশি সময় আগে। নদীপথে যোগাযোগের সুবিধার্থে কুশিয়ারা নদীকে কেন্দ্র করে হাটটি গড়ে উঠেছে। দূরদূরান্তের সঙ্গে যোগাযোগ, পণ্য আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে এই অঞ্চলের মানুষের নদীপথই ছিল ভরসা, অন্যতম মাধ্যম। এই পথে শুধু নৌকা নয়, একসময় লঞ্চও চলাচল করেছে। দূরবর্তী স্থানের সঙ্গে যোগাযোগের সুবিধা থাকায় নদীপথে বাঁশসহ অন্য পণ্য পরিবহন সহজ ছিল। হাটের সূচনাকাল থেকেই বাঁশের বাজার গড়ে উঠেছে। এই হাটে বালাগঞ্জ, নবীগঞ্জ, মার্কুলি, আজমিরিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, সিলেটের বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন এসে বাঁশ কিনে নিয়ে যান। আগের যোগাযোগব্যবস্থা এখন বদলে গেছে। এখন বাজারে আসা-যাওয়া করতে পাকা সড়ক হয়েছে। তাও নদীপথেই বেশি বাঁশ পরিবহন হয়ে থাকে। কাঁচা ঘর তৈরি, হাওরের বিভিন্ন বিলে বাঁশ পোঁতা, দালানকোঠা নির্মাণসহ নানা রকম কাজে এই বাঁশ ব্যবহার করা হয়।
বাঁশ ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, তাঁরা মৌলভীবাজার সদর, রাজনগর, শ্রীমঙ্গল, কুলাউড়াসহ বিভিন্ন এলাকার গ্রাম থেকে বাঁশ সংগ্রহ করে এ হাটে নিয়ে আসেন। ১০০ বা কুড়ি (২০) হিসাবে তাঁরা এই বাঁশ কিনে থাকেন। কালারবাজার-নলুয়ারমুখ হাটে প্রতিদিনই বাঁশ বেচাকেনা চলে। তবে সাপ্তাহিক হাট বসে সোম ও শুক্রবার—এ দুই দিন। এ দুই দিন দূরের মানুষ আসেন বাঁশ কিনতে। প্রতি হাটে দু-আড়াই লাখ টাকার বাঁশ বিক্রি হয়। শুক্রবার বেশি বাঁশ বিক্রি হয়। ওই দিন পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকার বাঁশ বিক্রি হয়। এ হাটে নিয়মিত ২৫ থেকে ৩০ জন ব্যবসায়ী আছেন, যাঁরা বারো মাসই এখানে বাঁশের ব্যবসা করেন। শীতের শুরু থেকে বর্ষা শুরুর মৌসুম পর্যন্ত বিক্রেতার সংখ্যা বেড়ে প্রায় ৫০–এ গিয়ে ঠেকে। বাঁশ ব্যবসায়ীদের প্রতিটি বাঁশের জন্য হাটের ইজারাদারকে দুই টাকা করে জমা দিতে হয়।
কালারবাজার-নলুয়ারমুখ হাট বাঁশের জন্য টিকে আছে কি না, এ নিয়ে কথা থাকতে পারে। কিন্তু এটা তো ঠিক, সব হাটে তো আর আলাদা করে চেনার মতো সব সময় কিছু থাকে না। কুশিয়ারা নদীর পারে গড়ে ওঠা কালারবাজার-নলুয়ারমুখ হাট এলাকার মানুষের মাছ–তরকারি-আনাজ, তেল-নুন–মসলা থেকে প্রতিদিনের টুকটাক চাহিদা মেটানোর যেমন অন্যতম একটি কেন্দ্র, তেমনি স্থানীয়সহ দূরদুরান্তের মানুষের বাঁশের প্রয়োজনীয়তাও মিটিয়ে চলছে শত বছর ধরে।