‘এই রোজগার দিয়ে নুন আনতে চাল নাই অবস্থা’

নওগাঁ শহরের লিটন সেতুর পূর্ব অংশে দিনমজুরের হাট বসে প্রতিদিন। সেই বাজারে শ্রম বিক্রির জন্য বসে আছেন শ্রমিকেরা। গত মঙ্গলবার সকালে তোলাছবি: প্রথম আলো

সেকেন্দার আলীর বয়স (৬০)। প্রতিদিন কোদাল আর ডালি নিয়ে বের হন কাজের সন্ধ্যানে। তিনি মূলত দিনমজুর। কখনো বালু-ইট বহনের কাজ করেন। আবার কখনো মাটির কাজ করেন। শ্বাসকষ্টের রোগী সেকেন্দারের ঠান্ডা লাগলে সমস্যা আরও বাড়ে।
গতকাল মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে নওগাঁ শহরের লিটন সেতুর পূর্ব পাশে তাজের মোড় এলাকায় কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তাজের মোড়ে অন্য শ্রমিকদের সঙ্গে শীতে জবুথবু হয়ে বসে কাজের জন্য অপেক্ষা করছিলেন তিনি।

সেকেন্দার আলীর বাড়ি নওগাঁ সদর উপজেলার মাদারমোল্লা গ্রামে। প্রতিদিন শ্রম বিক্রি করে সংসার চলে তাঁর। আলাপে জানা গেল, কিছুদিন ধরে নিয়মিত কাজ মিলছে না সেকেন্দারের। প্রতিদিন কাজ না মেলায় হতাশার সুরে তিনি বলেন, ‘হামি হাঁপানির (শ্বাসকষ্ট) রোগী। ঠান্ডা লাগলে হাঁপানি আরও বাড়ে। শীতের দিন বাড়িত থাকলে অ্যানা আরাম পাই। কিন্তুক হামাগের কি আর সেই সুখের কপাল। অসুখ শরীলেও প্যাটের তাগিদে যতই কষ্ট হোক, বাড়িত থেকে বের হতে হয়। প্রতিদিন কাজ প্যালে ভালো, না প্যালে সংসার চালাতে খুব কষ্ট হয়। ইদানীং কাজকাম নাই বললেই চলে। সপ্তাহে দুই-তিন দিন কাজ পাই। একে তো কামকাজ নাই, তার ওপর বাজারে চাল, ডাল, তেলসহ প্রায় সব জিনিসের দাম ব্যাড়ে গেছে। এই রোজগার দিয়ে নুন আনতে চাল নাই অবস্থা।’

সেকেন্দার আলী বলেন, ‘১০ বছরের বেশি সময় ধরে হাঁপানি অসুখে ভুগোছি। বউয়ের ডায়াবেটিস সমস্যা। দুজনাকেই নিয়মিত অষুধপথ্য খাওয়া লাগে। গরমের দিন একটু-আকটু ভালো থাকলেও শীতের দিন অসুখ ব্যাড়ে যায়। ডাক্তার বলে, বেশি ঠান্ডা-গরম লাগানো যাবে না। ভালো ভালো খ্যাতে হবে। সপ্তাহে ১০০০-১,২০০ টাকার ওষুধ লাগে। কখনো মাটি কাটা, আবার কখনো বালু-ইট বহনের কাজ করে যা পাই, তা–ই দিয়ে সংসার চলে। কিন্তুক ইদানীং কাজকাম নাই। খাইয়া না–খাইয়া থাকা লাগে। নিয়মিত ওষুধও কিনতে পারি না। দুই ছেলে ও দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলেরা আলাদা হয়ে থাকে। ওদেরও কষ্টে সংসার চলে। তারপরও পারলে মাঝেমধ্যে সাহায্য করে।’

সেকেন্দার আলীর মতো নওগাঁর লিটন সেতুর পূর্ব পাশে তাজের মোড়, মুক্তির মোড় নওজোয়ান মাঠ ও গোস্তহাটির মোড় এলাকায় প্রতিদিন ভোরে গ্রাম থেকে শহরে কাজের সন্ধ্যানে আসেন দিনমজুর শ্রমজীবী মানুষেরা। সাইকেল চালিয়ে বা ভ্যানে চড়ে আসা এই মানুষেরা সঙ্গে নিয়ে আসেন একটি ডালি আর কোদাল। শীতের কারণে গত ডিসেম্বর মাস থেকে কাজে ভাটা পড়েছে।

লিটন সেতুর রেলিংয়ের পাশে ডালি, কোদাল আর খাবারের পোঁটলা রেখে সেতুর রেলিংয়ের ওপর শীতে জবুথবু হয়ে বসে কাজের জন্য অপেক্ষা করছিলেন দিনমজুর আনোয়ারুল, জাহিদুল, রমজান আলী ও আবদুল কাদের। দিনমজুর রমজান বলেন, ‘মাঠে এখন আর ত্যামন কাম নাই। ধান কাটার কাজ শ্যাষ। আলু-পেঁয়াজ, শীতের সবজি লাগানোর কামও প্রায় শ্যাষ। এখন শহরের দিকে একটু-আকটু কাম পাওয়া যাছে। হামরা গরিব মানুষ। এক দিন কাম করলে ৫০০ টাকা পাই। সেটা দিয়েই সংসার চালানা লাগে। প্রতিদিন কাম করলে প্যাটে ভাত যায়, কাম না প্যালে আধপ্যাটা থাকা লাগে, কখনো–বা না খ্যায়েও থাকা লাগে।’

দিনমজুর আনোয়ারুল বলেন, ‘বড়লোকেগের মতো হামাগের তো দামি গরম কাপড় নাই। একটা পিরান আর চাদর পরে ভোরে যখন বাড়িত থ্যাকে ব্যার হই, তখন ঠান্ডাত হাত-পার রগত ট্যানে ধরে। কষ্ট করে চার-পাঁচ কিলোমটার দূরত থ্যাকে আসে বসে বসে থ্যাকে থ্যাকে অনেক দিন কাম পাই না। ইদানীং সপ্তাহে দুই-তিন দিন কাম মিলোছে। বাকি দিন বেকার বসে থাকা লাগোছে।’

তাজের মোড় যমুনা মার্কেটের একটি বন্ধ দোকানের সামনে বসে ছিলেন দিনমজুর জিয়ারুল ও গফুর আলী। আলাপচারিতায় গফুর আলী বলেন, ‘দুই দিন কামের জন্য আসে ফিরে গেছি। আজকে সকাল সাড়ে ছয়টাত থেকে বসে আছি। এখন ৮টা বাজে। কেউ কামত নিল না। একার রোজগারে সংসারে পাঁচটা মানুষের মুখত ভাত দিতে হয়। শীত-গরম নাই, যতই কষ্ট হোক, গতর খ্যাটাতে পারলে হামাগের প্যাটেত ভাত যায়, না পারলে না খ্যায়ে থাকা লাগে।’

গত সোমবার নওগাঁর বদলগাছী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণকেন্দ্রে দিনের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ১২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আগের দিন রোববার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১১ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

বদলগাছী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণকেন্দ্রের পর্যবেক্ষক মিজানুর রহমান বলেন, তাপমাত্রা একটু বেড়েছে। তবে এটি আবহাওয়া কমে যাবে। আজ পৌষের ৩০ তারিখ। মাঘ মাস পড়লে উত্তরের হিমেল বাতাসের তীব্রতা বাড়ে। তখন শীতের তীব্রতা বাড়ে। এ ছাড়া চলতি মাসে শৈত্যপ্রবাহ আসার পূর্বাভাসও রয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তরের।