৫০০ বছরের ইতিহাস জড়ানো এক মসজিদ

ঐতিহাসিক ছুটি খাঁ মাসজিদ। চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের দেওয়ানপুর গ্রামেছবি: প্রথম আলো

আজ থেকে প্রায় ৫০০ বছর আগে ১৫১৯ থেকে ১৫৩২ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রামের উত্তরাঞ্চলের শাসনকর্তা ছিলেন ছুটি খাঁ। তাঁর বাবা পরাগল খাঁ ছিলেন হোসেন শাহী আমলে চট্টগ্রামের সেনা অধ্যক্ষ ও প্রাদেশিক শাসনকর্তা। পিতামহ রাস্তি খাঁ ছিলেন সুলতান রুকনুদ্দিন বারবক শাহের রাজত্বকালে চট্টগ্রামের শাসনকর্তা।

ছুটি খাঁ একজন দক্ষ শাসক ও বীর যোদ্ধা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। ত্রিপুরার তৎকালীন রাজা ধন্য মাণিক্য ১৫১৩ ও ১৫১৫ খ্রিষ্টাব্দে দুই দফা চট্টগ্রাম আক্রমণ করলে ছুটি খাঁ বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে ত্রিপুরা বাহিনীকে পরাজিত করে তাদের বিতাড়িত করেন। এ সময় তিনি ত্রিপুরা রাজ্যের বিস্তীর্ণ অংশ নিজের দখলে আনেন বলে ধারণা করা হয়।

ছুটি খাঁ শুধু দক্ষ যোদ্ধা ও শাসক ছিলেন না, ধর্ম পালন ও জনগণের ভালোমন্দের প্রতিও তাঁর মনোযোগ ছিল। শাসনকালে তিনি দিঘি খনন ও মসজিদ স্থাপনসহ নানা জনহিতকর কাজ করে গেছেন। তাঁর স্মৃতি বহন করা তেমন একটি স্থাপনা ছুটি খাঁ মসজিদ। ৫০০ বছরের ইতিহাস জড়ানো ঐতিহাসিক ছুটি খাঁ মসজিদ এখন প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপনা। মসজিদটির প্রাচীন অবকাঠামো ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ায় এর কিছু অংশ সংরক্ষণ করা হয়েছে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরে। ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় মসজিদটি দেখতে এখন মিরসরাই আসেন দেশ-বিদেশের মানুষ।

১৫১৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ছুটি খাঁ মসজিদের অবস্থান চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের দেওয়ানপুর গ্রামে। পুরোনো ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পশ্চিম পাশে সুবিশাল ছুটি খাঁ দিঘির পূর্ব পাড়ে স্থাপিত প্রাচীন মসজিদটির অস্তিত্ব এখন বিলীন হয়ে গেছে। সেখানে পড়ে আছে প্রাচীন মসজিদের খিলানের মতো মনে হয়—এমন বেলে পাথরের ধ্বংসাবশেষ। আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পোড়ামাটির নকশা করা ইটের অলংকরণ। ধ্বংসপ্রাপ্ত পশ্চিম দেয়ালের একাংশ এবং কোণে সন্নিহিত বুরুজের অবশেষ কয়েক বছর আগপর্যন্তও ছিল। মসজিদের কেন্দ্রীয় মিহরাবেও পোড়ামাটির লতাপাতার নকশা এবং শিকল ও ঘণ্টার মোটিফ দ্বারা সুশোভিত ছিল। ধ্বংসাবশেষ পরীক্ষায় দেখা যায়, এখানে ছয় গম্বুজ বিশিষ্ট হোসেন শাহী আমলের মসজিদের অস্তিত্ব ছিল। মসজিদটির তিন খিলানযুক্ত প্রবেশপথ তিন মিহরাবের সমান্তরালে পশ্চিম দেয়াল অবধি বিস্তৃত ছিল। মসজিদে নামাজের স্থানটি দুই স্তম্ভ পথ দ্বারা তিনটি লাইনে বিভক্ত ছিল।

ছুটি খাঁ মসজিদের ভেতরের অংশে এখনো আদিকালের স্থাপনার চিহ্ন রয়ে গেছে। চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের দেওয়ানপুর গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

ইতিহাসবিদ আহমদ মমতাজ তাঁর লেখা মিরসরাইয়ের ইতিহাস বইতে উল্লেখ করেছেন, প্রত্নতত্ত্ববিদদের ধারণা পঞ্চদশ শতাব্দীতে এ মসজিদ তৈরি করতে ভারতের রাজস্থান ও অন্যান্য প্রদেশ থেকে পাথর ও বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী আনা হয়েছে। মসজিদ তৈরিতে ব্যবহার করা অনেক পাথরে তোগরা হরফে অনেক আয়াত লেখা আছে। মসজিদের ভেতরে আছে একাধিক শিলালিপি। এগুলোর একটিতে লেখা আছে আয়াতুল কুরসি। মসজিদটির পশ্চিম পাশে টিকে থাকা প্রাচীন দেয়ালে এখনো এসব শিলালিপি চোখে পড়ে।

পশ্চিম পাশের দেয়ালের কিছু অংশ রেখে প্রাচীন মসজিদের জায়গায় এখন স্থাপন করা হয়েছে নতুন একটি মসজিদ। সেটির দৈর্ঘ্য ৭৬ ফুট ও প্রস্থ ২১ ফুট। ১৬ ফুট উচ্চতার দুটি মিনার–সংবলিত মসজিদটিতে একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন ৭৫০ জন মুসল্লি।

স্থানীয় বাসিন্দা ও মসজিদটির নিয়মিত মুসল্লি মো. কামাল উদ্দিন জানান, অন্যান্য দিনের তুলনায় শুক্রবার এই মসজিদে মুসল্লি হয় বেশি। সেদিন জুমার নামাজ আদায় করতে আসেন স্থানীয় লোকজনসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ।

মসজিদটির বর্তমান সভাপতি মাহমুদ নজরুল বলেন, ‘ছুটি খাঁ মসজিদ এই অঞ্চলের সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ। ইতিহাস ঐতিহ্য ও প্রত্নতত্ত্বের জায়গা থেকে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপনা। মসজিদ দেখতে দূর–দূরান্ত থেকে বেশি বিদেশি লোক আসেন। কিন্তু এই মূল্যবান স্থাপনাটি সংরক্ষণে প্রত্নতত্ত্ব ও অধিদপ্তর বা সরকারি কোনো সংস্থার উদ্যোগ নেই। আমরা নিজেদের চেষ্টায় প্রাচীন মসজিদটির পরিত্যক্ত পাথর, ইট, খিলানসহ  বিভিন্ন সামগ্রী সংরক্ষণের জন্য আলাদা একটি ঘর তৈরি করব। আমরা মনে করি এই ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাটি সংরক্ষণে সরকারি সংস্থাকে এগিয়ে আসা উচিত।’

যেভাবে আসবেন

দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে ঐতিহাসিক ছুটি খাঁ মসজিদ দেখতে আসতে চাইলে প্রথমে মিরসরাইয়ের বারৈয়ারহাট পৌর বাজারে নামতে হবে। সেখান থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় সহজেই চলে আসা যাবে এই মসজিদ দেখতে। ভালো মানের থাকা–খাওয়ার ব্যবস্থা আছে বারৈয়ারহাট পৌর বাজারেই।