সাইকেল নিয়ে ৬৪ জেলা ভ্রমণে ১৮ বছরের তরুণ, বায়ুদূষণ রোধের বার্তা

‘সাইক্লিং করি বায়ুদূষণ রোধ করি’ এই বার্তা নিয়ে ৬৪ জেলা ঘুরছেন রাহাত ইসলাম। গতকাল মঙ্গলবার মাগুরা স্টেডিয়ামের সামনেছবি: প্রথম আলো

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তাঁর আঠারো বছর বয়স কবিতায় লিখেছিলেন, ‘আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ/ স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি,/ আঠারো বছর বয়সেই অহরহ/ বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।’

কবির কবিতার মতোই ১৮ বছর বয়সী মো. মাজাহারুল ইসলামের মনে যেন ‘বিরাট দুঃসাহস’ উঁকি দেয়। এরপর তিনি বাইসাইকেলে ৬৪ জেলা ভ্রমণে বের হয়ে পড়েন। এই ভ্রমণের মধ্য দিয়ে তিনি একটি বার্তাও মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চান। সেটি হচ্ছে, ‘সাইক্লিং করি বায়ুদূষণ রোধ করি’। এই তরুণ মনে করেন, নাগরিকেরা মোটরসাইকেল ও ব্যক্তিগত মোটরযান ছেড়ে বাইসাইকেলে অভ্যস্ত হলে বায়ুদূষণ অনেকাংশে কমে আসবে। সড়ক দুর্ঘটনাও কম হবে।

গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে মাগুরা জেলা পরিষদের প্রধান ফটকে দেখা হল তরুণ এই সাইক্লিস্টের সঙ্গে। হেলমেট ও সানগ্লাস পরা তরুণের বাইসাইকেলের সামনে নিজের নামের পাশাপাশি লেখা ‘সাইক্লিং করি বায়ুদূষণ রোধ করি’।

তিনি জানালেন, কাগজে–কলমে নাম মো. মাজাহারুল ইসলাম রাহাত হলেও রাহাত ইসলাম নামেই তিনি বেশি পরিচিত। বাড়ি সিলেট সদরের কুমারপাড়ায়। শামসুল ইসলাম ও রহিমা বেগম দম্পতির ৬ সন্তানের মধ্যে সবার বড় রাহাত। বর্তমানে সিলেটের জামিয়া দারুল ফালাহ নামে একটি প্রতিষ্ঠানে মাদানী নেসাব (আরবি সাহিত্য) তৃতীয় বর্ষে পড়ালেখা করছেন। অবসর সময় কাটানোর জন্য বাইসাইকেলকে বেছে নিয়েছেন এই তরুণ।

বাইসাইকেল চালিয়ে রাহাত ইসলামের দূরদূরান্তে ছুটে চলার ‘নেশা’ তৈরি হয় বছরখানেক আগে। তখন ‘লং রাইডারস কমিউনিটি’ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপে যুক্ত হন তিনি। এই গ্রুপের সদস্যরা বাইসাইকেলে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যান। গত বছর প্রথমে সিলেট বিভাগের প্রতিটি উপজেলায় বাইসাইকেলে ভ্রমণ করেন রাহাত। এরপর লক্ষ্য নির্ধারণ করেন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া যাবেন। গত ২১ ফেব্রুয়ারি বায়ুদূষণ রোধের বার্তা নিয়ে তেঁতুলিয়া থেকে যাত্রা শুরু করেন রাহাত। ৮ দিনে তিনি টেকনাফে পৌঁছান।

নাটোরের রাজবাড়ির সামনে তরুণ সাইক্লিস্ট রাহাত ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত

এবার তাঁর লক্ষ্য ৬৪ জেলায় ঘোরা। গত ঈদুল ফিতরের পরদিন (১ এপ্রিল) ছোট ব্যাগে প্রয়োজনীয় কিছু কাপড় ও সাইকেলের সরঞ্জাম নিয়ে ঘর ছাড়েন রাহাত ইসলাম। প্রথমে সাইকেল চালিয়ে সুনামগঞ্জ যান। সেখান থেকেই শুরু হয় আনুষ্ঠানিক যাত্রা। নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর হয়ে প্রবেশ করেন রাজধানী ঢাকায়। এভাবে গত ১৫ দিনে ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটারের বেশি সাইকেল চালিয়ে ৩২তম জেলা মাগুরায় পৌঁছেছেন।

গত সোমবার রাতে তিনি ছিলেন চুয়াডাঙ্গায়। সেখান থেকে সকালে যাত্রা শুরু করে ঝিনাইদহ হয়ে দুপুরে পৌঁছেছেন মাগুরায়। এর পরের গন্তব্য রাজবাড়ী হয়ে ফরিদপুর। এই তরুণের ধারণা, ৬৪ জেলা ভ্রমণ শেষে সিলেট পৌঁছাতে ৩০ থেকে ৩২ দিন সময় লাগতে পারে। এই ভ্রমণে দিনে গড়ে ১১০ কিলোমিটার সাইকেল চালানো এই তরুণ এক দিনে সর্বোচ্চ ১৭৬ কিলোমিটার বাইসাইকেল চালিয়েছেন বলে জানান।

ভ্রমণের ক্ষেত্রে প্রতিটি জেলা সদরে প্রবেশ করছেন রাহাত ইসলাম। এই যাত্রাপথে বিভিন্ন জেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থান পরিদর্শন করছেন তিনি। সেগুলোর ছবিও নিয়মিত নিজের ফেসবুকে পোস্ট করছেন। এই তরুণ প্রথম আলোকে বলেন, ‘যাওয়ার পথের আশপাশে বিভিন্ন জায়গা দেখেছি। মসজিদ, মন্দিরসহ নানা রকম পুরাতন স্থাপনা। বগুড়ার মহাস্থাগড়, নাটোরের রাজবাড়ি, পাবনা মেন্টাল হাসপাতাল, কুষ্টিয়ায় লালন শাহের মাজার, মেহেরপুরের মুজিবনগরসহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থাপনা দেখেছি। অনেক মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে।’

এই ভ্রমণে খাওয়ার পেছনেই মূলত খরচ হয় তাঁর। গত ১৫ দিনের মধ্যে দুই দিন থাকতে হয়েছে হোটেলে। বেশির ভাগ দিনই বিভিন্ন জেলার সাইক্লিস্ট কমিউনিটির লোকজন তাঁকে নিজের বাসায় থাকতে দিয়েছেন। তিনি বলেন, একেক জেলায় একেক রকম পরিবেশ। সবার কথাবার্তা এক না। নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে দেখা হচ্ছে, পরিচয় হচ্ছে। নতুন অনুভূতি, নতুন শিক্ষা।

বগুড়ার মহাস্থানগড়ে তরুণ সাইক্লিস্ট রাহাত ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত

রাহাত ইসলাম জানান, পড়ালেখার পাশাপাশি টিউশনি ও মসজিদে নামাজ পড়িয়ে নিজের খরচের টাকা জোগাড় করেন। আর ভ্রমণের জন্য আগে থেকেই অল্প অল্প করে টাকা জমাতে থাকেন। এই সাইকেল ভ্রমণে পরিবারেরও সমর্থন আছে উল্লেখ করে এই তরুণ বলেন, ‘এখন মোবাইল আমাদের অনেক সময় নষ্ট করে দেয়। আমি মোবাইল থেকে বাইসাইকেলকে বেশি গুরুত্ব দেই। বাইসাইকেল আপনাকে দূরে নিয়ে যাবে, কিন্তু খারাপ করবে না। আমার বাবাও এ কারণে বাধা দেন না। আমি যেকোনো কাজ বা ঘোরা, সব সময়ই বাইসাইকেল ব্যবহার করি।’

রাহাত মনে করেন, শুধু বাইসাইকেল চালানোর অভ্যাস তৈরি হলে পরিবেশ সুরক্ষার পাশাপাশি মানুষ অনেক বিপদ থেকে সুরক্ষিত থাকতে পারে। তিনি বলেন, ‘আমরা যদি সাইকেলে অ্যাক্সিডেন্ট করি খুব বেশি ক্ষতি হবার সম্ভাবনা কম। আর যদি মোটর সাইকেলে অ্যাকসিডেন্ট হয় তাহলে বাঁচার সম্ভাবনা অনেকাংশে কম। একটু সময় বেশি লাগলেও এটা নিরাপদ এবং আপনার শরীরকে সুস্থ রাখবে। তা ছাড়া যানজট ও পরিবেশদূষণও কমে যাবে।’