অপ্রতিরোধ্য ছিলেন আওয়ামী গডফাদার শাজাহান খান

  • ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকারের পতনের পর আত্মগোপনে চলে যান শাজাহান খান ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা।

  • ৫ সেপ্টেম্বর শাজাহান খানকে এবং ২৬ সেপ্টেম্বর তাঁর ছেলে আসিবুর রহমান খানকে গ্রেপ্তার করা হয়।

  • পেট্রলপাম্প, পরিবহন, হোটেলসহ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আবার চালুর চেষ্টা।

জাসদের রাজনীতি ছেড়ে আওয়ামী লীগে আসেন শাজাহান খান। শ্রমিকনেতা হিসেবে পরিচিত শাজাহান খান বর্তমানে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। টানা আটবারের এই সংসদ সদস্য (এমপি) দুই মেয়াদে নৌপরিবহনমন্ত্রী ছিলেন। ব্যক্তিগত ক্যাডার বাহিনীর মাধ্যমে তিনি মাদারীপুরে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘খান-লীগ’। তাঁদের দাপটে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও অতিষ্ঠ। ভাই ও স্বজনদের মাধ্যমে জেলার প্রায় সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ছিল তাঁর একক আধিপত্য। জমি দখল, কমিশন–বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি—সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি।

শাজাহান খান মাদারীপুর-২ (সদর-রাজৈর) আসনের সাবেক এমপি। মাদারীপুরে তাঁর বিকল্প কেউ নেই বলে মনে করে তাঁর পরিবার। খান পরিবারের সিদ্ধান্তের বাইরে সদর ও রাজৈরে কোনো কাজ হতো না। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের বাড়িও মাদারীপুর শহরে। আওয়ামী লীগের শাসনামলের পুরোটা এই দুই কেন্দ্রীয় নেতার দ্বন্দ্ব জাতীয়ভাবেও আলোচিত। পরিবহন শ্রমিকনেতা হিসেবে বিগত আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরে এই খাতের চাঁদার অন্যতম নিয়ন্ত্রক ছিলেন শাজাহান খান।

ব্যক্তিগত ক্যাডার বাহিনীর মাধ্যমে তিনি মাদারীপুরে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘খান-লীগ’। তাঁদের দাপটে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও অতিষ্ঠ।

শাজাহান খান ২০১৩ সালে গড়ে তোলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন মঞ্চ। ২০১৯ সালে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হন। এ সময় তাঁর বিরুদ্ধে অমুক্তিযোদ্ধাদের টাকার বিনিময়ে সনদ পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। ২০১৫ সালে গড়ে তোলেন শ্রমিক-কর্মচারী-পেশাজীবী ও মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় পরিষদ। সর্বশেষ জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঠেকাতে তিনি ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক মিলে গড়ে তোলেন মুক্তিযোদ্ধা সন্তান ও প্রজন্ম সমন্বয় পরিষদ।

নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামা অনুযায়ী, ১৫ বছরে শাজাহান খানের আয় বেড়েছে ৩২ গুণ। শাজাহান খানের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সার্বিক কনস্ট্রাকশন, সার্বিক শিপিং লাইন চট্টগ্রাম, সার্বিক ইন্টারন্যাশনাল হোটেল, সার্বিক পেট্রলপাম্প সবকিছুই তাঁর স্বজনদের নামে। মাদারীপুর-ঢাকা ও ঢাকা-বরিশাল সড়কপথে আধিপত্য বিস্তারকারী সার্বিক পরিবহন তাঁর মালিকানাধীন। সার্বিক পরিবহনের নামে বর্তমানে দুই শতাধিক গাড়ি চলাচল করছে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাঁর ছেলে আসিবুর রহমান খান।

আরও পড়ুন

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকারের পতনের পরপরই আত্মগোপনে চলে যান শাজাহান খান ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা। ৫ সেপ্টেম্বর রাতে রাজধানীর ধানমন্ডি থেকে শাজাহান খানকে এবং ২৬ সেপ্টেম্বর বিমানবন্দর থেকে তাঁর ছেলে আসিবুর রহমান খানকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এরপরও তাঁদের ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না এলাকাবাসী।

ভাই ও স্বজনদের মাধ্যমে জেলার প্রায় সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ছিল তাঁর একক আধিপত্য। জমি দখল, কমিশন–বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি—সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি।

যেভাবে উত্থান

১৯৬৪ সালে ছাত্ররাজনীতি দিয়ে হাতেখড়ি। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে মাদারীপুর জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি হন শাজাহান খান। জাসদে যোগ দিয়ে জেলা জাসদের যুগ্ম আহ্বায়ক হন। ১৯৮৬ সালে স্বতন্ত্র হিসেবে প্রথমবারের মতো এমপি হন। ১৯৯১ সালে জাসদ ছেড়ে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি হন। এরপর প্রতিটি সংসদে তিনি এমপি ছিলেন। ২০০৯ থেকে টানা ১০ বছর নৌমন্ত্রী ছিলেন তিনি।

স্থানীয় প্রায় সব নির্বাচনে পরিবারের বাইরে কাউকে সুযোগ না দেওয়ায় দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে শাজাহান খানের দূরত্ব বাড়ে। সর্বশেষ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেলেও জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা তাঁর পক্ষে প্রচারে নামেননি।

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের কয়েক ঘন্টা পরই শাজাহান খান ও তাঁর ভাইদের বাসভবন ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। ৫ আগস্ট বিকেলে মাদারীপুর শহরের কলেজ গেটের সামনে
ছবি: প্রথম আলো

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজল কৃষ্ণ দে প্রথম আলোকে বলেন, ‘শাজাহান খান কখনোই আওয়ামী লীগ করেন নাই। তিনি ব্যক্তি-লীগ করেছেন। তিনি একক ক্ষমতার অপব্যবহার করে দমন-নিপীড়ন করেছেন; যা নিয়ে আমাদের মধ্যে বহু বছর ধরেই বিভেদ ও দ্বন্দ্ব লেগে ছিল।’

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকারের পতনের পরপরই আত্মগোপনে চলে যান শাজাহান খান ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা। ৫ সেপ্টেম্বর রাতে রাজধানীর ধানমন্ডি থেকে শাজাহান খানকে এবং ২৬ সেপ্টেম্বর বিমানবন্দর থেকে তাঁর ছেলে আসিবুর রহমান খানকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এরপরও তাঁদের ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না এলাকাবাসী।

ভাইদের দিয়ে সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ

একসময় শাজাহান খানের পুরো সিন্ডিকেট (চক্র) নিয়ন্ত্রণ করতেন তাঁরই চাচাতো ভাই জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও দুবারের উপজেলা চেয়ারম্যান পাভেলুর রহমান খান। তাঁর সঙ্গে দ্বন্দ্বের পর ছোট ভাই ওবায়দুর রহমান খানকে সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বানান শাজাহান খান। ওবায়দুর আইনজীবী সমিতির সভাপতি হওয়ায় আদালতপাড়ায় ছিল তাঁর আধিপত্য। কেউ শাজাহান খানের বিরুদ্ধে গেলেই মামলার আসামি বানিয়ে হয়রানি করা হতো।

শাজাহান খানের আরেক ভাই হাফিজুর রহমান খান। তিনি মাদারীপুর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি। সবার কাছে ‘নানা’ হিসেবে পরিচিত হাফিজুর জেলার ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি কার্যালয় নিয়ন্ত্রণ করতেন। তিনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সার্বিক কনস্ট্রাকশনের প্রধান। জেলার ৮০ ভাগ উন্নয়নকাজ ওই প্রতিষ্ঠান পেত। অন্য ঠিকাদারদের কাছে কমিশনের মাধ্যমে কাজ বিক্রি করে দিতেন তিনি। পাসপোর্ট কার্যালয়, বিআরটিএ, সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, থানাসহ বেশ কয়েকটি কার্যালয়ে হাফিজুরের একক আধিপত্য ছিল। ওই কার্যালয়গুলোতে হাফিজুরের নিয়োগ করা লোকজনকে কমিশন না দিলে ফাইল নড়ত না।

শাজাহান খান কখনোই আওয়ামী লীগ করেন নাই। তিনি ব্যক্তি-লীগ করেছেন। তিনি একক ক্ষমতার অপব্যবহার করে দমন-নিপীড়ন করেছেন; যা নিয়ে আমাদের মধ্যে বহু বছর ধরেই বিভেদ ও দ্বন্দ্ব লেগে ছিল
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজল কৃষ্ণ দে

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পাসপোর্ট কার্যালয়ের সামনের এক দোকানি বলেন, ‘এখানে যারা দালালি করত, বেশির ভাগই খান গ্রুপের লোক। তারা শাজাহান খান ও তাঁর ভাইয়ের প্রভাব খাটিয়ে সেবাপ্রত্যাশীদের ফাইল জমা দিত। প্রতি ফাইল থেকে এক-দেড় হাজার টাকা কমিশন নিত।’

জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের এলএ শাখার ভূমি অধিগ্রহণ শাখা থেকে কমিশন নিতেন হাফিজুরের কর্মী আক্তার হোসেন। সরকার পতনের দিন জেলা প্রশাসনের তালিকাভুক্ত এই দালালের বাড়িতেও হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। বর্তমানে তিনি আত্মগোপনে আছেন।

শাজাহান খানের বিলাসবহুল ১০ তলা ভবনটি মেরামতের কাজ করছেন শ্রমিকেরা। ছবিটি ৫ অক্টোবর তোলা
ছবি: প্রথম আলো

শাজাহান খানের চাচাতো ভাই পাভেলুর রহমান খান বলেন, ‘আমি তাঁর সঙ্গে দীর্ঘদিন রাজনীতি করলেও তাঁর সম্পদ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। শাজাহান খান যখন মন্ত্রী, তখন তাঁর সুপারিশ ছাড়া জেলায় কিছুই হতো না। স্থানীয় সরকারি চাকরিতেও তাঁর হস্তক্ষেপ ছিল।’ তিনি বলেন, শাজাহান খানের দ্বারা আওয়ামী লীগের লোকজন উপকৃত হয়নি। গত ১৫ বছরে তিনি ভাই, ছেলে ও আত্মীয়স্বজন দিয়ে সিন্ডিকেট করে সব নিয়ন্ত্রণ করতেন।

সর্বশেষ উপজেলা নির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নিজের ছেলেকে চেয়ারম্যান পদে ভোট করান এবং জয়ী করেন শাজাহান খান। পরে ছেলেকে মাদারীপুর জেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতিও করেন প্রভাব খাটিয়ে।

আমি তাঁর সঙ্গে দীর্ঘদিন রাজনীতি করলেও তাঁর সম্পদ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। শাজাহান খান যখন মন্ত্রী, তখন তাঁর সুপারিশ ছাড়া জেলায় কিছুই হতো না। স্থানীয় সরকারি চাকরিতেও তাঁর হস্তক্ষেপ ছিল।
শাজাহান খানের চাচাতো ভাই পাভেলুর রহমান খান

ফাউন্ডেশন খুলে চাঁদাবাজি

মন্ত্রী থাকতে বাবা আচমত আলী খানের নামে একটি ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন শাজাহান খান। সংগঠনটির কোনো স্থায়ী ও অস্থায়ী কার্যালয় নেই। প্রতিবছর বড় পরিসরে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। সেখানে সরকারের মন্ত্রী ও শিল্পপতিদের রাখা হতো।

সংগঠন সূত্র জানায়, নৌমন্ত্রী থাকতে শাজাহান খান ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু বছরে একবার ঠোঁটকাটা–তালুকাটা রোগীদের চিকিৎসার জন্য বিনা মূল্যে মেডিকেল ক্যাম্প ছাড়া কোনো সেবামূলক কাজই হয়নি। শাজাহান খান বিভিন্ন ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে ফাউন্ডেশনের জন্য টাকা দিতে বাধ্য করতেন বলেও অভিযোগ আছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যবসায়ী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার প্রতিষ্ঠানের একটি বড় কাজ দেওয়ার বিনিময়ে কমিশন বাবদ ওই ফাউন্ডেশনে ১০ লাখ টাকা অনুদান দিতে হয়েছে। তখন কমিশন না দিলে আমি কাজ করতে পারতাম না। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও ভয় পেয়ে তখন টাকাটা দিতে হয়েছে।’

অভিযোগের বিষয়ে ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা রনি খান বলেন, ফাউন্ডেশনের সব কার্যক্রম এখন বন্ধ। এখানে সবকিছুই দেখভাল করতেন তিনি (শাজাহান) নিজেই। তাই সংগঠনের কী আছে কী নেই, তিনি ছাড়া কেউ বলতে পারবেন না।

সংগঠন সূত্র জানায়, নৌমন্ত্রী থাকতে শাজাহান খান ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু বছরে একবার ঠোঁটকাটা–তালুকাটা রোগীদের চিকিৎসার জন্য বিনা মূল্যে মেডিকেল ক্যাম্প ছাড়া কোনো সেবামূলক কাজই হয়নি। শাজাহান খান বিভিন্ন ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে ফাউন্ডেশনের জন্য টাকা দিতে বাধ্য করতেন বলেও অভিযোগ আছে।

মন্ত্রী থাকতে নিয়োগ-বাণিজ্য

শাজাহান খান ১০ বছর নৌমন্ত্রী থাকাকালে মাদারীপুরে তাঁর অন্তত ৩ হাজার কর্মীকে বিআইডব্লিউটিএ, বিআইডব্লিউটিসিসহ বিভিন্ন বিভাগে চাকরি দিয়েছেন বলে বিভিন্ন সভায় বক্তব্য দিয়েছেন। প্রতিটি চাকরির জন্য শাজাহান খান ও তাঁর ভাইয়েরা ৮ থেকে ১২ লাখ টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। নিয়োগ-বাণিজ্যে মূল তদারকি করতেন শাজাহান খানের তৎকালীন বিশেষ সহকারী রণজিৎ বণিক।

অভিযোগের বিষয়ে রণজিৎ বণিক প্রথম আলোকে বলেন, শাজাহান খান মন্ত্রী থাকতে জেলার অনেক যুবক চাকরি পেয়েছেন। কিন্তু কারও কাছ থেকে কোনো টাকা নেওয়া হয়নি।

অবশ্য বিআইডব্লিউটিসিতে চাকরি করা মাদারীপুরের এক যুবক প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০১৬ সালে আমার চাকরি হয়। এ জন্য সেই সময় নগদ একসঙ্গে ১০ লাখ টাকা রণজিৎ নিজে আমার পরিবারের কাছ থেকে গ্রহণ করেন। চাকরিটাও হইছে। তাই কোনো অভিযোগ নাই।’

মন্ত্রী থাকা অবস্থায় শাজাহান খানের ছেলে আসিবুর ও স্ত্রী সৈয়দা রোকেয়া বেগমের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম বন্দরে বিপুল কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে। নৌপরিবহন মন্ত্রণলায়ের অধীন জাহাজ মেরামত ও নদী খননের ব্যবসা করেন আবদুর রশিদ। আছে বিভিন্ন পথে চলাচলকারী জাহাজও। কর্ণফুলী নদী দখল করে চট্টগ্রাম বন্দর এলাকায় রশিদের মালিকানাধীন ‘ড্রাই ডক’ নির্মাণে সুযোগ দেন শাজাহান খান। কুমিল্লায় রশিদের গ্রামের বাড়িতে দাওয়াতও খান শাজাহান খান।

২০০৯ সাল থেকে পরিবহন খাতে প্রকাশ্যে যানবাহনপ্রতি ৭০ টাকা চাঁদা আদায় শুরু হয়। এর মধ্যে ৪০ টাকা যায় মালিক সমিতির হাতে। আর শ্রমিক ইউনিয়নের ১০ টাকা এবং ফেডারেশনের ১০ টাকা। বাকি ১০ টাকা সড়ক শৃঙ্খলায় নেওয়া হতো। এর বাইরে অপ্রকাশ্য চাঁদা উঠত। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সব মিলিয়ে এই খাতে বছরে চাঁদার পরিমাণ অন্তত ১ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা।

পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি

রাজনীতির বাইরে শাজাহান খানের বড় পরিচয় তিনি পরিবহন শ্রমিকনেতা। সারা দেশের শ্রমিকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি। শ্রমিকনেতা হলেও তাঁর পরিবারের মালিকানায় সার্বিক পরিবহন নামে বাসের ব্যবসা রয়েছে।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শাজাহান খান জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল ও উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন। এ দুই কমিটির মূল কাজ ছিল সড়কে শৃঙ্খলা আনা এবং এ খাতে চাঁদাবাজি বন্ধ করা। কিন্তু তিনিই আবার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করতেন। সড়ক নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার সব দাবি আদায়ে সদা সক্রিয় থেকেছেন।

২০০৯ সাল থেকে পরিবহন খাতে প্রকাশ্যে যানবাহনপ্রতি ৭০ টাকা চাঁদা আদায় শুরু হয়। এর মধ্যে ৪০ টাকা যায় মালিক সমিতির হাতে। আর শ্রমিক ইউনিয়নের ১০ টাকা এবং ফেডারেশনের ১০ টাকা। বাকি ১০ টাকা সড়ক শৃঙ্খলায় নেওয়া হতো। এর বাইরে অপ্রকাশ্য চাঁদা উঠত। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সব মিলিয়ে এই খাতে বছরে চাঁদার পরিমাণ অন্তত ১ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা।

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর শাজাহান খান ও তাঁর ভাইদের বাসভবন ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। ৫ আগস্ট বিকেলে মাদারীপুর শহরের কলেজ গেটের সামনে
ছবি: প্রথম আলো

পরিবহন খাতের সূত্র বলছে, ফেডারেশন হিসেবে সরাসরি চাঁদা তোলার নিয়ম নেই। কিন্তু শাজাহান খান প্রতি যানবাহন থেকে দিনে ১০ টাকা চাঁদা তুলেছেন। এর বাইরে তাঁর ফেডারেশনের অধীন সারা দেশে ২৪৯টি শ্রমিক ইউনিয়ন আছে। তারাও প্রতি যানবাহন থেকে প্রতিদিন ১০ টাকা চাঁদা উঠিয়েছে।

বিআরটিএ সূত্র জানায়, সারা দেশে বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, হিউম্যান হলার, অটোরিকশাসহ নিবন্ধিত বাণিজ্যিক যানবাহনের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ছয় লাখ। প্রতিদিন শ্রমিকদের জন্য ২০ টাকা করে আদায় হলে চাঁদা ওঠে সোয়া কোটি টাকা। শ্রমিক কল্যাণে টাকা তুললেও করোনা মহামারির সময় ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের কোনো সহায়তা দেওয়া হয়নি।

একাধিক শ্রমিকনেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, চাঁদার টাকা প্রতিদিন রাতে বস্তায় ভরে মতিঝিলে ফেডারেশনের কার্যালয়ে আসত। মতিঝিলে জাতীয় স্টেডিয়ামের পূর্ব গেটের পাশে থাকা ভবনটির মালিকও শাজাহান খানের পরিবার। সেখানে তাঁর শ্রমিক সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়।

সরকারি কাজে কমিশন

মাদারীপুরের বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), পানি উন্নয়ন বোর্ড, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, গণপূর্ত, স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, পৌরসভাসহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের উন্নয়ন প্রকল্পের কে কোন কাজ পাবেন, সেটা ঠিক করে দিতেন শাজাহান খানের ভাই হাফিজুর রহমান খান। তাঁকে প্রকল্পের মোট বরাদ্দের ১০ থেকে ক্ষেত্রবিশেষে ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন দিতে হতো।

এলজিইডির ঠিকাদার মুরাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সড়ক বিভাগ থেকে দরপত্র হলেই তিনি (হাফিজুর) কাউকে কাজ দিতেন না। নিজে কাজ নিয়ে আরও পাঁচজনকে অংশীদার রাখতেন। ওই দরপত্র থেকেই গত পাঁচ বছরে তাঁর আয় হয়েছে অন্তত ৫০ কোটি টাকা। তবে এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী বাদল কীর্তনীয়া বলেন, ‘তাঁদের সব দরপত্র অনলাইনে জমা দিতে হয়। এখানে যোগসাজশের কোনো সুযোগ নেই। কমিশন নেওয়ার বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই।’

তাঁর দুই ছেলে ও মেয়ের নামে মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ঢাকা, টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন এলাকায় বিপুল সম্পদ আছে বলে জানা গেছে। খান পরিবারের ব্যবসা ব্র্যান্ডিং ‘সার্বিক’ নামে। এই নামে শাজাহান খান ও তাঁর স্বজনদের নামে হোটেল, পরিবহন, অবকাঠামো নির্মাণসহ বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে।

বিপুল সম্পদের পাহাড়

২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামা অনুযায়ী, শাজাহান খানের বার্ষিক আয় ছিল ৬ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের সময় হলফনামায় তিনি আয় দেখিয়েছেন ২ কোটি ২১ লাখ টাকা। অর্থাৎ ১৫ বছরে তাঁর আয় বেড়েছে প্রায় ৩২ গুণ। একই সময়ে তাঁর অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে পাঁচ গুণ। হলফনামা অনুযায়ী, শাজাহান খানের দুটি গাড়ি এবং স্ত্রীর নামে ৮০ ভরি সোনা ছাড়া আর কোনো অস্থাবর সম্পদ দেখানো হয়নি। ২০০৮ সালে দুটি বাস, একটি গাড়ি ও একটি মাইক্রোবাস, ১৫ ভরি সোনাসহ প্রায় ৪১ লাখ টাকার সম্পদ দেখানো হয়েছিল।

শাজাহান খান ও তাঁর স্ত্রীর বেশ কিছু কৃষি ও অকৃষিজমি আছে। প্রায় ৬ কোটি টাকার ভবন ও সমজাতীয় স্থাপনা আছে। দান সূত্রেও ফ্ল্যাট ও জমির মালিক হয়েছেন তিনি। তাঁর স্ত্রীর নামে আছে রাজউকের ১০ কাঠার প্লট ও অন্যান্য স্থাবর সম্পদ। তবে তাঁর দুই ছেলে ও মেয়ের নামে মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ঢাকা, টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন এলাকায় বিপুল সম্পদ আছে বলে জানা গেছে। খান পরিবারের ব্যবসা ব্র্যান্ডিং ‘সার্বিক’ নামে। এই নামে শাজাহান খান ও তাঁর স্বজনদের নামে হোটেল, পরিবহন, অবকাঠামো নির্মাণসহ বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে।

অবশ্য হলফনামায় উল্লিখিত সম্পদের বিবরণ খতিয়ে দেখা হয় না। এটা প্রকৃত হিসাব নয় বলে মনে করেন অনেকে।

জমি-বাড়ি

১৫ বছর আগে নৌমন্ত্রী হওয়ার পর ক্ষমতার দাপট দেখানো শুরু করেন শাজাহান খান। এরপর তিনি ও তাঁর স্বজনদের সম্পদ বাড়তে থাকে। মাদারীপুর পৌরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ডে একাধিক বহুতল ভবন, জমি, মার্কেট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। যদিও এসব সম্পদের বেশির ভাগই স্ত্রী, সন্তান ও ভাইদের নামে করা হয়েছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, পৌর শহরের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে হাফিজুর রহমান খানের জমি, সরকারি অর্পিত সম্পত্তি ইজারা নিয়ে করা ১৬টি দোকান ও পাটকল আছে। ৭ নম্বর ওয়ার্ডে এক একর জমিতে অস্থায়ী দোকান, ৬ নম্বর ওয়ার্ডে দুটি বহুতল ভবন, একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি, দুটি বাণিজ্যিক ভবন, একটি বিলাসবহুল পাঁচতলা আবাসিক হোটেল ও রেস্তোরাঁ আছে। একই এলাকায় শাজাহান খানের ১০ তলা ভবন আছে। শাজাহানের আরেক ভাই ওবায়দুর রহমানের দুটি বহুতল বাড়ি আছে। থানার সামনে শাজাহানের ছোট ছেলে শামস খানের পাঁচতলা নতুন ভবন, পাশেই হাফিজুর রহমান ও খান পরিবারের যৌথ মালিকানাধীন হাসপাতাল, ৩ নম্বর ওয়ার্ডে পুরান বাজারে জমি আছে। পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ড চৌরাস্তা ও কুলপদ্বী এলাকায় জমি ও বাড়ি আছে।

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর শাজাহান খানের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। ছবিটি ৫ আগস্ট বিকেলে মাদারীপুর শহরের কলেজ গেটের সামনে
ছবি: প্রথম আলো

কলেজ রোডের বাসিন্দা মাহাবুবুর রহমান বলেন, শহরের যেখানেই হাফিজুরের জমি পছন্দ হতো, তিনি প্রভাব খাটিয়ে কিনে নিতেন। আবার যে জমিতে মামলা-মোকদ্দমা আছে, সেগুলো লক্ষ্য করে কম দামে কিনে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিতেন। ভয়ে কেউ মুখ খুলতেন না।

হাফিজুরের কেনা তিনটি জমির আগের মালিকের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। কিন্তু কেউ নাম প্রকাশ করতে চাননি। তিনজনেরই দাবি, জমি নিয়ে বিরোধ ও মামলা চলায় প্রভাব খাটিয়ে হাফিজুর রহমান খান মাত্র ৩ কোটি টাকায় কিনেছেন। কিন্তু জমির বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা।

শাজাহান খানের বিপুল সম্পদের ব্যাপারে কথা বলতে তাঁর পরিবারের দায়িত্বশীল কাউকে পাওয়া যায়নি। স্থানীয় সূত্র জানায়, শাজাহান খানের দুই ভাই ও স্বজনদের অনেকে দেশত্যাগ করেছেন। শাজাহান খান ও তাঁর বড় ছেলে আসিবুর বর্তমানে কারাগারে।

মালিকপক্ষের নির্দেশনায় আমরা কাজ করছি। তাঁদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পরিবহন, পাম্প ও হোটেল চালু করেছি। বাসভবনগুলো থেকে পোড়া ময়লার স্তূপ সরিয়ে ফেলা হয়েছে। চেষ্টা করছি নতুন করে আবার সবকিছু করার।
সার্বিক নামের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক গোপাল হালদার

ব্যবসা চালুর চেষ্টা

সরকার পতনের দিন বিকেলে শাজাহান খানের বিলাসবহুল ১০ তলা বাসভবনে আগুন দেওয়া হয়। তখন হাফিজুর ও ওবায়দুর রহমান খানের মালিকানাধীন চারটি ভবন, দুটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, হোটেল ও রেস্তোরাঁয় অগ্নিসংযোগ করা হয়। তবে এর আগেই শাজাহান খান ও তাঁর ভাইয়েরা আত্মগোপনে চলে যান। সম্প্রতি তাঁদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বিলাসবহুল বাড়িগুলো নতুন করে মেরামতের কাজ করছেন শ্রমিকেরা।

সার্বিক নামের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক গোপাল হালদার বলেন, ‘মালিকপক্ষের নির্দেশনায় আমরা কাজ করছি। তাঁদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পরিবহন, পাম্প ও হোটেল চালু করেছি। বাসভবনগুলো থেকে পোড়া ময়লার স্তূপ সরিয়ে ফেলা হয়েছে। চেষ্টা করছি নতুন করে আবার সবকিছু করার।’

৫ অক্টোবর সরেজমিনে দেখা যায়, ইতিমধ্যে সার্বিক পেট্রলপাম্প, পরিবহন ব্যবসা ও হোটেল চালু হয়েছে।

সচেতন নাগরিক কমিটির মাদারীপুরের সভাপতি খান মোহাম্মদ শহীদ প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণ দৃষ্টিতেই শাজাহান খান ও তাঁর পরিবারের সম্পদ সবার চোখে দৃশ্যমান। ১৫ বছরে একজন জনপ্রতিনিধির এমন পরিবর্তনে সবাই বিস্মিত। কিন্তু ভয়ে কখনো কেউ কিছু বলেনি। শুধু শাজাহান খান নন, দেশে গত ১৫ বছরে জবাবদিহি ছিল না বলে দুর্নীতি ও অনিয়ম ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এমন জনপ্রতিনিধিদের আইনের আওতায় এনে বিচার নিশ্চিত ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্পদ জব্দের দাবি জানান তিনি।