‘ছেলেটা পঙ্গু হয়ে গেছে, মোগো সংসার ক্যামনে চলবে জানি না’

গুলিবিদ্ধ আরিফুল ইসলাম বিছানায় শুয়ে আছেন। তাঁর পাশে মা, স্ত্রী ও তিন মাসের ছেলে সন্তান। বুধবার পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার নতুন শ্রীনগর গ্রামেছবি: প্রথম আলো

আরিফুল ইসলাম (২৪) এখন গ্রামের বাড়িতে শয্যাশায়ী। ঢাকায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় গুলিতে আহত হন তিনি। তাঁর বাঁ পায়ে চারটি গুলি লেগেছিল। হাসপাতালে এক মাস চিকিৎসার পর বাড়ি ফিরেছেন। কিন্তু পায়ের ব্যান্ডেজ এখনো খোলা হয়নি। গুলির ক্ষত শুকায়নি। আগামী মাসে আরও একটি অস্ত্রোপচার করতে ঢাকায় যেতে হবে তাঁকে।

আরিফুল ইসলাম ঢাকার মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বরে ফুটপাতে ভ্যানে করে আতর, টুপিসহ ইসলামিক জিনিসপত্র বিক্রি করে সংসার চালাতেন। মা-বাবার ভরণপোষণ ও ছোট তিন ভাইয়ের লেখাপড়ার খরচ, স্ত্রী ও এক ছেলেসন্তানের খরচ—সবই চলত তাঁর আয়ে। তিনি এখন কর্মহীন হয়ে পড়ায় পরিবারের সদস্যরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার মাধবখালী ইউনিয়নের নতুন শ্রীনগর গ্রামের মো. হারুন অর রশিদের ছেলে আরিফুল। দুই বছর আগে বিয়ে করেন তিনি। গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকায় এক মাস চিকিৎসা নিয়ে গত শনিবার গ্রামের বাড়ি ফিরেছেন। গতকাল বুধবার সরেজমিনে আরিফুলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, জরাজীর্ণ একটি টিনশেড ঘরে আরিফুল খাটের ওপর শুয়ে আছেন। বাঁ পায়ের কিছু অংশে ব্যান্ডেজ ও গুলির ক্ষতস্থান। পায়ের নিচের অংশে চারপাশে রিং পরানো। নড়াচড়া করতে পারছেন না। পাশেই তাঁর তিন মাসের শিশুসন্তান আরাফ হোসেন ঘুমিয়ে আছে। স্ত্রী ও বৃদ্ধ মা আরিফুলের সেবা-শুশ্রূষা করছেন। প্রতিবেশীরা তাঁকে দেখতে এসেছেন।

আলাপকালে আরিফুল ইসলাম বলেন, অভাবের সংসারে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে বৃদ্ধ বাবাকে সাহায্য করতে সংসারের ভার কাঁধে নিয়ে পাঁচ বছর আগে কাজের সন্ধানে ঢাকায় যান। এক বন্ধুর সহায়তায় মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বরে ভ্যানে করে আতর-টুপিসহ ইসলামিক জিনিসপত্র বিক্রি শুরু করেন। এতে যে লাভ হতো, বাড়িতে মা-বাবা ও ভাইদের লেখাপড়ার খরচ কোনো রকম চলত। এখন তো কর্মহীন হয়ে পড়ে বিপাকে আছেন।

১৮ জুলাই থেকে মিরপুর গোলচত্বরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গেই ছিলেন আরিফুল ইসলাম। তাঁর ভাষ্য, ৪ আগস্ট দুপুর ১২টার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে মিরপুর আইডিয়াল গার্লস স্কুলের পেছনের গলিতে এসে কয়েক হাজার ছাত্র-জনতার সঙ্গে একত্র হন। ওই দিন বিকেল চারটার দিকে ছাত্রদের মিছিলে যোগ দিয়ে মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বরের দিকে যান। তখন সেখানে সেনাবাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। কিছুক্ষণ পর সেনাসদস্যরা চলে গেলে ফায়ার সার্ভিস ভবনের ওপর থেকে মিছিলে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। মুহূর্তেই সেখানে এক শিশুসহ পাঁচজন গুলিবিদ্ধ হন। গুলিবিদ্ধ ১০ বছরের শিশুটিকে উদ্ধার করে নিরাপদ  স্থানে সরিয়ে নেওয়ার সময় পরপর চারটি গুলি এসে তাঁর বাঁ পায়ে লাগে। এর মধ্যে দুটি গুলি পা ছিদ্র হয়ে বের হয়ে যায়। তখন সড়কে লুটিয়ে পড়েন। এ সময় ছাত্ররা তাঁকে অ্যাম্বুলেন্সে করে মিরপুর-১১ নম্বরে ইসলামিয়া হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। পরে আগারগাঁও অর্থোপেডিক হাসপাতালে ভর্তি করেন। এরপর তাঁর স্বজনদের খবর দেওয়া হয়। প্রথম দিকে চিকিৎসা খরচ নিজেরা চালিয়েছেন। এতে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। পরে ছাত্ররা চিকিৎসা খরচ ফ্রি করে দিলেও পরিবারের তো অনেক খরচ। সেই খরচ জোগাতে না পারায় পরিবারের সদস্যদের মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে। শিশুসন্তানের খাবার, মা–বাবার ওষুধ ও ছোট ভাইদের লেখাপড়ার খরচ বহন করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তাঁর বাবা কাঁঠালতলী বেসরকারি সংস্থা আশা অফিসে পিয়ন পদে চাকরি করেন। বাবার একার সামান্য আয় দিয়ে সংসার আর চলছে না।

এত দিন বড় ভাইয়ের আয়ে তাঁদের পড়াশোনার খরচ চলত। এখন পেটের ভাতই জোটে না আর লেখাপড়া। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, লেখাপড়া ছেড়ে ঢাকায় যাবেন কাজের সন্ধানে।
হাসিব, নিহত আরিফুলের ছোট ভাই
গুলিবিদ্ধ আরিফুল নিজ বাড়ির বিছানায় শুয়ে আছেন। বুধবার পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার নতুন শ্রীনগর গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মির্জাগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তরিকুল ইসলাম বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ আরিফুল ইসলামের পরিবারকে উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে ২০ হাজার টাকার একটি অনুদানের চেক পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে চিকিৎসার জন্য ১০ হাজার টাকার একটি আবেদন পাঠানো হয়েছে। এই টাকাও তিনি স্বল্প সময়ের মধ্যে পেয়ে যাবেন।

আরিফুলের ছোট ভাই হাসিব প্রথম আলোকে বলেন, এত দিন বড় ভাইয়ের আয়ে তাঁদের পড়াশোনার খরচ চলত। এখন পেটের ভাতই জোটে না আর লেখাপড়া। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, লেখাপড়া ছেড়ে ঢাকায় যাবেন কাজের সন্ধানে।

আরিফুলের মা শামীমা বেগম আহাজারি করে বলেন, ‘ছেলেটা পঙ্গু হয়ে গেছে, মোগো সংসার ক্যামনে চলবে জানি না।’

আক্ষেপ করে শামীমা আরও বলেন, তাঁর ছেলে মনে হয়, আর কোনো দিন হাঁটতে পারবেন না। ছেলের বাবা যে আয় করেন, তাতে সংসার চলে না। মেজ ছেলে হাসিব বেতাগী রহমতপুর আলিম মাদ্রাসায় আলিম দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে। সেজ ছেলে হামিম বাজিতা ছালেহিয়া দাখিল মাদ্রাসায় ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। ছোট ছেলে তামিম নতুন শ্রীনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে লেখাপড়া করে। বড় ছেলে অসুস্থ হওয়ায় ওদের লেখাপড়াও আর হবে কি না জানেন না।