তিন ফসলি জমিতে ইপিজেড করার পাঁয়তারা বন্ধ করতে হবে: সুলতানা কামাল
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেছেন, তিন ফসলি জমিতে ইপিজেড (বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা) স্থাপনে ভূমি অধিগ্রহণের যে পাঁয়তারা চলছে, তা বন্ধ করতে হবে। ফসলি জমিতে কোনো রকম স্থাপনা হতে পারে না। এটা রাষ্ট্রের নীতি। প্রধানমন্ত্রী নিজেও বারবার বলে যাচ্ছেন, কোনো ফসলি জমি নষ্ট করে যেন স্থাপনা না হয়।
আজ সোমবার দুপুরে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতাল সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন। উপজেলার কাটামোড় এলাকায় এ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটি, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, এএলআরডি, আদিবাসী-বাঙালি সংহতি পরিষদ ও গাইবান্ধা সামাজিক সংগ্রাম পরিষদ এ সমাবেশের আয়োজন করে।
সুলতানা কামাল বলেন, ভূমি উদ্ধারের আন্দোলন করতে গিয়ে সাঁওতালদের ওপর গুলি চালানো হয়েছে। তিন সাঁওতাল নিহত হয়েছেন। সেটার বিচার তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে চাচ্ছেন। এ বিচার আটকে রাখা হয়েছে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থেকে মুক্তিযুদ্ধের আলোকে দেশ পরিচালনা করছে। যদি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার হয়ে দেশ চালাতে হয়, তাহলে কিন্তু সরকারকে এই সাধারণ মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের চেষ্টা করতেই হবে। এ উন্নয়ন করতে হলে তাঁদের ফসলের জমিতে হাত দেওয়া চলবে না। তাঁদের ওপর যদি কোনো রকম অত্যাচার হয়, নির্যাতন হয়, সেটার সুবিচার করতে হবে।
সুলতানা কামাল আরও বলেন, ‘আমরা এসডিজিতেও (টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা) স্বাক্ষর করেছি। সেখানে বলা হয়েছে, কাউকে পেছনে ফেলে রাখা যাবে না। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর যাঁরা পিছিয়ে আছেন, তাঁদের সামনে নিয়ে আসার জন্য কাজ করতে হবে। তাঁদের যে দাবিগুলো রয়েছে, যেমন সংখ্যালঘু কমিশন, তাঁদের সুরক্ষা কমিশন, সমতলের আদিবাসীদের জন্য আলাদা কমিশন, সেগুলো যেন গঠিত হয়।’
সভায় সভাপতিত্ব করেন সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ফিলিমন বাক্সে। বক্তব্য দেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের উপদেষ্টা কাজল দেবনাথ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, আদিবাসী-বাঙালি সংহতি পরিষদের আহ্বায়ক সিরাজুল ইসলাম, গাইবান্ধা সামাজিক সংগ্রাম পরিষদের সদস্যসচিব জাহাঙ্গীর কবির, নাগরিক সংগঠন জনউদ্যোগের সদস্যসচিব প্রবীর চক্রবর্তী, আদিবাসী নেতা সুফল হেমব্রম, থোমাস হেমব্রম, নিরঞ্জন পাহান, মানবাধিকারকর্মী গোলাম রব্বানী প্রমুখ।
রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, পৃথিবী জুড়ে খাদ্যের মূল্য বেড়ে গেছে। শস্যের ফলন কমে গেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি রাখা যাবে না। এই অবস্থায় বাগদা ফার্মের জমিতে কোনো অবস্থায় স্থাপনা করা ঠিক হবে না।
এর আগে সকাল নয়টায় সাঁওতালপল্লির মাদারপুর ও জয়পুর গ্রাম থেকে তির-ধনুক, ব্যানার, বিভিন্ন দাবিদাওয়া–সংবলিত ফেস্টুন নিয়ে একটি মিছিল বের হয়। মিছিলটি ১০ কিলোমিটার পথ ঘুরে গোবিন্দগঞ্জ-দিনাজপুর সড়কের কাটামোড়ে গিয়ে শেষ হয়। সেখানে দুপুরে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে পাঁচ শতাধিক সাঁওতাল অংশ নেন।
এর আগে ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্মের জমিতে আখ কাটাকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে সাঁওতালদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে পুলিশসহ উভয় পক্ষের অন্তত ৩০ জন আহত হন। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে তিন সাঁওতাল—শ্যামল, মঙ্গল ও রমেশ মারা যান। ২৬ নভেম্বর থোমাস হেমব্রম বাদী হয়ে ৩৩ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ৫০০–৬০০ জনকে অজ্ঞাতপরিচয় দেখিয়ে আরেকটি মামলা করেন।
পরে হাইকোর্ট মামলা দুটি এক করে পিবিআইকে (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) তদন্তের নির্দেশ দেন। ২০১৯ সালের ২৩ জুলাই তদন্তকারী কর্মকর্তা মামলার চূড়ান্ত অভিযোগপত্র গোবিন্দগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে জমা দেন। মামলার গুরুত্বপূর্ণ ১১ আসামির নাম বাদ দিয়ে ৯০ জনের নামে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।
একই সালের ৪ সেপ্টেম্বর মামলার বাদী থোমাস হেমব্রম অভিযোগপত্রের বিষয়ে আদালতে নারাজি পিটিশন দেন। আদালত শুনানি শেষে বিষয়টির আরও তদন্ত করতে ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনকে (সিআইডি) নির্দেশ দেন। সিআইডি ২০২০ সালের ২ নভেম্বর আদালতে একই ধরনের অভিযোগপত্র দাখিল করে। ২০২১ সালের ৪ জানুয়ারি বাদী থোমাস হেমব্রম পুনরায় নারাজি দেন। নারাজির ওপর শুনানির তারিখ দফায় দফায় পেছাচ্ছে।