মাদারীপুরে ফেসবুকে অপপ্রচারের অভিযোগে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা, কারাগারে শিক্ষক
মাদারীপুরে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা নিয়োগের ভুয়া প্রজ্ঞাপন ফেসবুকে শেয়ার করায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষককে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ওই মামলায় পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষে তাঁকে গতকাল মঙ্গলবার আদালতে হাজির করা হয়। পরে বিচারক তাঁকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
গ্রেপ্তার জসিম ব্যাপারী (৩৯) ডাসার উপজেলার পূর্ব কমলাপুর গ্রামের সোমেদ ব্যাপারীর ছেলে। তিনি উপজেলার আলহাজ সৈয়দ আতাহার আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। এ ছাড়া তিনি বাংলাদেশ প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক পরিষদের সিনিয়র সহসভাপতি।
১৩ মার্চ ডাসার থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আবুল কালাম আজাদ বাদী হয়ে নিরাপত্তা, সংহতি, জননিরাপত্তা বিনষ্ট করার অপরাধ সংঘটন ও সংঘটনের প্রচেষ্টার অভিযোগে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একটি মামলা করেন। এ ঘটনায় জসিম ব্যাপারীকে আসামি করা হয়। এর আগে ১২ মার্চ দিবাগত রাত দেড়টার দিকে উপজেলার ধামুসা এলাকায় নিজ বাড়ি থেকে তাঁকে আটক করে পুলিশ। পরে পুলিশ তাঁর ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে। আদালত ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। জসিম ব্যাপারীকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে গতকাল দুপুরে আদালতে হাজির করা হয়। পরে আদালত তাঁকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও ডাসার থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সাইফুল ইসলাম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রাথমিক তদন্ত ও জিজ্ঞাসাবাদে অনেকে কিছুই জানা গেছে। তিনি (জসিম) তিনটি ফেসবুক পেজ ও সাতটি গ্রুপের অ্যাডমিন থেকে তিনি নিজেই পরিচালনা করেন। এখানে শিক্ষক আন্দোলন থেকে শুরু করে নানা বিষয়ে তিনি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। জসিম ব্যাপারীর ফেভারেই (পক্ষেই) আছে সবকিছু। তিনি (শিক্ষক) ভালো মানুষ। কিছু কিছু কাজ করেন অ্যাডভান্স লেভেলের (আগ বাড়িয়ে)। মামলাটি তদন্তাধীন, তাই এর বেশি কিছু বলা যাচ্ছে না।’
সন্ত্রাসীবিরোধী কাজে জড়িত থাকার বিষয় জানতে চাইলে সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘জসিম ব্যাপারী ১২ মার্চ তাঁর পরিচালিত একটি পেজে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পদে শপথের জন্য আটজনের নামসহ একটি ভুয়া প্রজ্ঞাপন শেয়ার করেন। হয়তো তিনি সেটা না বুঝে শেয়ার করেছেন। ওই শিক্ষকের সঙ্গে কোনো অন্যায় করা হবে না। তিনি যেন ন্যায়বিচার পান, সেটাই নিশ্চিত করা হবে। এই সপ্তাহের মধ্যেই তদন্ত শেষ করে দেব।’
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, শিক্ষক জসিম ডাসার উপজেলার ধামুসা এলাকায় ভাড়া বাসায় পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। ওই বাসায় বসে তিনি বাংলাদেশ সরকার/প্রজাতন্ত্রের সংহতি, জননিরাপত্তা এবং সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করার জন্য জনসাধারণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশের নিরাপত্তা, সংহতি, জননিরাপত্তা বিনষ্ট করার অপরাধ সংঘটন ও সংঘটনের প্রচেষ্টা করছেন। তাঁর ব্যবহৃত মুঠোফোনের গ্যালারি থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে ইস্যু করা একটি ভুয়া প্রজ্ঞাপন পাওয়া গেছে। ওই প্রজ্ঞাপন ২১ মার্চ প্রকাশিত হওয়ার কথা থাকলেও রাষ্ট্রকে তথা বাংলাদেশ অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব¡বিপন্ন করার উদ্দেশ্যে ভুয়া গেজেট তৈরি করে অপপ্রচার চালানোর পরিকল্পনা করেন।
জসিম ব্যাপারীর আইনজীবী এনামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘জুলাইয়ে ছাত্র–জনতার আন্দোলন চলাকালীন শিক্ষক জসিম ফেসবুকে অন্তত ৫০০ পোস্ট করেছেন। তখন পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেনি। আর এখন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের নিয়ে করা একটি নিউজ আর ভাইরাল হওয়া প্রজ্ঞাপনটি শেয়ার করায় আমার মক্কেলকে সন্ত্রাসী বানানো হলো। এটি পুরোটাই একটি মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা। তাঁর সম্মান বিনষ্ট করতেই এই মামলা সাজানো হয়েছে।’
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের নিয়ে করা একটি নিউজ আর ভাইরাল হওয়া প্রজ্ঞাপনটি শেয়ার করায় আমার মক্কেলকে সন্ত্রাসী বানানো হলো। এটি পুরোটাই একটি মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা। তাঁর সম্মান বিনষ্ট করতেই এই মামলা সাজানো হয়েছে।এনামুল হক, গ্রেপ্তার হওয়া শিক্ষকের আইনজীবী
ওই শিক্ষকের পরিবার ও সহকর্মীদের অভিযোগ, শিক্ষকেরা যেন প্রাপ্যটা বুঝে পান এবং ১০ম গ্রেডে উন্নীত হতে পারেন—তাই জসিম ব্যাপারী প্রাথমিক শিক্ষকদের ন্যায়ের পক্ষে থেকে আন্দোলন করে আসছিলেন। শিক্ষকদের এই আন্দোলন ঘিরে ফেসবুক ও পেজে তিনি বিভিন্ন সময় নানাবিধি লেখাও প্রকাশ করেছেন। জসিম ব্যাপারীকে চাপে রাখতে ও তাঁকে দমন করতে ষড়যন্ত্র করে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে এই মামলা করা হয়েছে।
জসিম ব্যাপারীর বড় ভাই ইলিয়াস ব্যাপারী বলেন, ‘আমার ভাই ন্যায়ের পক্ষে ছিল। তাই তাকে ষড়যন্ত্র করে মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। আমার ভাই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নয়। তাকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে পুলিশ মামলা দিয়ে জেলে বন্দী করেছে।’
জসিম ব্যাপারীর মুক্তির দাবিতে তাঁর সহকর্মীরা ফেসবুকে সরব হয়েছেন। সাইদুর রহমান নামের একজন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘শিক্ষক জসিম ন্যায়ের পক্ষে কথা বলেছেন, বৈষম্যের বিরোধিতা করেছেন। আর তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হলো। এই হলো বাংলাদেশ। কিছুই বলার নেই...।’
চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত
এদিকে জসিম ব্যাপারীর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা হওয়ার পর ১৬ মার্চ চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে মাদারীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘সহকারী শিক্ষক জসিম ব্যাপারী সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলায় গ্রেপ্তারের খবর জানাজানি হলে ১৬ মার্চ তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করে প্রাথমিক অধিদপ্তর। মামলা চলাকালীন তিনি শুধু খোরাকি ভাতা পাবেন। এই মামলার বিষয় আমাদের কোনো মন্তব্য নেই।’
এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করলে ডাসার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মো. এহতেশামুল ইসলাম নিজেকে ব্যস্ততা দেখিয়ে ফোন কেটে দিতে চান। পরে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মামলাটি তদন্তাধীন। পুলিশি হয়রানি বিষয় প্রশ্ন করা হলে তিনি ফোন কেটে দেন।