ওরা দরিদ্র পরিবারের সন্তান। ঠিকমতো তিন বেলা খাবারই জোটে না। সেখানে পড়াশোনা অনেকটা বিলাসব্যসনের মতো। তবু ওরা পিছপা হয়নি। কেউ টিউশনি করেছে, কেউ রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ করেছে, কেউ করেছে দিনমজুরি। পরিবারের হাল ঠিক রেখে নিজের পড়ার খরচ জুগিয়েছে।
ভালো ফলও করেছে। এবার এসএসসি পরীক্ষায় রংপুরের ইনছানা, পিরোজপুরের রুবেল, রাজবাড়ীর সুমাইয়া ও নাটোরের আসিফ জিপিএ–৫ পেয়েছে। তাদের নিয়ে আশায় আছে পরিবার, বুনছে স্বপ্ন। কিন্তু আর্থিক অনটন সেই স্বপ্নের পথে বাধা। অদম্য মেধাবীরা সেই বাধা ডিঙিয়ে জীবনে সাফল্যের সোপানের সন্ধান চায়।
টিউশনি করে পড়েছে ইনছানা
রংপুরের তারাগঞ্জে দরিদ্র পরিবারের মেয়ে ইনছানা খাতুন। টিউশনি করে নিজের পড়ার খরচ জোগাত। এ বছর সে ঘনিরামপুর বড়গোলা উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় মানবিক বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে। ভালো ফলের পরও ইনছানা ও তাঁর পরিবার দুশ্চিন্তায় আছে।
উপজেলার রহিমাপুর জাফরপাড়ায় ইনছানার বাড়ি। দুই ভাই, এক বোনের মধ্যে ছোট সে। দিনমজুর বাবা এমদাদুল হক বলেন, ‘মোর খুব আশা ছাওয়ার ঘরোক মানুষ কইরার। নিজে যেটা পাও নাই মোর ছাওয়াগুলা যেন তাক পায়। ওরা লেখাপড়া করি যেন মানুষ হয়। অভাব বুঝি মোর ছাওয়াগুলাক ভালো করি লেখাপড়া কইরার দিবার নেয়।’
দিনমজুরি করেছে রুবেল
বাবা আবদুল ওহাব ছিলেন কৃষিশ্রমিক। কোমরব্যথার কারণে কাজ ছেড়েছেন। মা মাকসুদা বেগম কাজ করতেন ঢাকায়। বছর দুই আগে হাতিরঝিল এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। সেই থেকে পরিবারের দেখভালের দায়িত্ব এসে পড়ে মো. রুবেলের ওপর। সংসার চালাতে দিনমজুরি করত। এই করেই এবার সে এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ–৫ পেয়েছে। রুবেলদের বাড়ি পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার ঘোপখালী গ্রামে।
রুবেলের স্কুল উপজেলার বেতমোর রাজপাড়া ইউনিয়ন আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক দেলোয়ারা বেগম বলেন, ‘রুবেল মেধাবী ছাত্র। পরিবারটি অত্যন্ত দরিদ্র। সে কষ্ট করে পড়াশোনা করেছে। আমি তার পড়াশোনায় সাধ্যমতো সহযোগিতা করেছি। এসএসসিতে ভালো ফল করেও ছেলেটি পড়াশোনার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত।’
সুমাইয়ার পড়া নিয়ে দুশ্চিন্তা
নদীভাঙা, দরিদ্র পরিবারের মেয়ে সুমাইয়া আক্তার। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রতিটি ক্লাসে সে প্রথম হয়েছে। তিন বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সুমাইয়া তৃতীয়। সে এবার রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া আক্কাছ আলী হাইস্কুল থেকে মানবিক বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে। গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া আইনদ্দিন ব্যাপারীপাড়ার রশিদ মণ্ডলের মেয়ে সে। পারিবারিক অনটনের কারণে সে–ও টিউশনি করে নিজের পড়ার খরচসহ সংসারের খরচ চালাত। সামনের দিনগুলোতে পড়ার খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে সুমাইয়ার পরিবার।
দৌলতদিয়া আক্কাছ আলী হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. জাকির হোসেন বলেন, এই অঞ্চলের অধিকাংশ পরিবার নদীভাঙনের শিকার। পড়াশোনায় তাদের তেমন আগ্রহ নেই। সেখানে সুমাইয়া অনেক ভালো করেছে। সহযোগিতা পেলে মেয়েটা ভালো কিছু করতে পারবে।
রাজমিস্ত্রির জোগালি ছিল আসিফ
শারীরিক অক্ষমতার কারণে সংসারের কাজ করতে পারতেন না আছমা বেগম। আসিফ হোসেনের বয়স যখন তিন বছর, তখন মা নানাবাড়ি চলে আসেন। সামান্য কিছু প্রতিবন্ধী ভাতা ও ভাইদের সহযোগিতায় কোনো রকম চলেছেন। নিজের পড়ার খরচ জোগাতে মামাদের সঙ্গে রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ করত আসিফ। হাড়ভাঙা খাটুনির পরও পড়াটা ঠিকঠাক চালিয়ে গেছে। সে এবার নাটোর সদর উপজেলার আগদিঘা উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ–৫ পেয়েছে। বড় হয়ে ডাক্তার হতে চায় আসিফ।
বিদ্যালয়ের গণিতের শিক্ষক শাহীনুর রহমান বললেন, আসিফ আরও ভালো করত। কিন্তু রাজমিস্ত্রির কাজ করতে যাওয়ায় নিয়মিত ক্লাস করতে পারেনি। প্রাইভেট পড়ার সুযোগ পায়নি।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন প্রতিনিধি, নাটোর; তারাগঞ্জ, রংপুর; পিরোজপুর ও গোয়ালন্দ, রাজবাড়ী]