১৫ থেকে ২০ বছর আগেও সাধারণ জীবন যাপন করতেন। ছিলেন মুদিদোকানি। জাতীয় পার্টি দিয়ে রাজনীতিতে হাতেখড়ি। তারপর যোগ দেন আওয়ামী লীগে। পদ–পদবি পেয়ে যান, হন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান। এর মধ্যে তাঁর এক আত্মীয় পুলিশের বড় কর্মকর্তা হন। সেই পরিচয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করতে থাকেন। সামান্য মতবিরোধেই মানুষকে মামলায় জড়িয়ে হয়রানি করতে থাকেন।
এলাকায় গড়ে তোলেন সন্ত্রাসী বাহিনী। যেখানেই যেতেন, কয়েকটি মোটরসাইকেলে সন্ত্রাসী বাহিনী ঘিরে থাকত তাঁকে। অনিয়ম-দুর্নীতি, অবৈধভাবে বালু বিক্রি, সালিসের নামে টাকা নেওয়া, জুয়ার আসর বসানো, পুলিশে চাকরি দেওয়ার কথা বলে টাকা নেওয়াসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত ছিলেন।
১৪ জুন রাত ১০টার দিকে পেশাগত দায়িত্ব পালন শেষে সাংবাদিক গোলাম রব্বানি বাড়ি ফিরছিলেন। পথে বকশীগঞ্জের পাটহাটি এলাকায় মাহমুদুলের নেতৃত্বে তাঁকে টেনেহিঁচড়ে উপর্যুপরি কিল-ঘুষি ও বেদম মারধর করা হয়।
এত অভিযোগ যাঁর বিরুদ্ধে, তিনি মাহমুদুল আলম ওরফে বাবু (৫০)। এলাকায় সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা মাহমুদুল কদিন আগেও জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলার সাধুরপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ছিলেন ইউপির টানা দুবারের চেয়ারম্যান। সর্বশেষ তাঁর নেতৃত্বে সন্ত্রাসীদের পিটুনিতে অনলাইন পোর্টাল বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জামালপুর জেলা প্রতিনিধি ও একাত্তর টেলিভিশনের উপজেলা সংবাদ সংগ্রাহক গোলাম রব্বানি নিহত হন বলে র্যাব জানিয়েছে। সেই মামলায় তিনিসহ ১৩ জন বর্তমানে কারাগারে। গত শুক্রবার দল থেকে বহিষ্কারের পর গতকাল সোমবার মাহমুদুলকে চেয়ারম্যানের পদ থেকেও সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ।
১৪ জুন রাত ১০টার দিকে পেশাগত দায়িত্ব পালন শেষে সাংবাদিক গোলাম রব্বানি বাড়ি ফিরছিলেন। পথে বকশীগঞ্জের পাটহাটি এলাকায় মাহমুদুলের নেতৃত্বে তাঁকে টেনেহিঁচড়ে উপর্যুপরি কিল-ঘুষি ও বেদম মারধর করা হয়। একপর্যায়ে অচেতন হয়ে পড়লে সন্ত্রাসীরা তাঁকে ফেলে পালিয়ে যায়। পরের দিন দুপুরে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। মাহমুদুলের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশের জের ধরে ওই হামলার ঘটনা ঘটে বলে জানা গেছে।
তাঁকে আমি অনেক পরামর্শ দিয়েছি। বলতাম, দেখো তুমি বড় হয়েছ, মানুষের ভালোবাসা পেতে হলে অনেক সময় ছোটও হতে হয়। কিন্তু কখনো এসব পরামর্শ নিতেন না তিনি
রাজনীতি ছিল ঢাল
সাধুরপাড়া ইউনিয়নের কামালের বার্ত্তী গ্রামে মাহমুদুল আলমের বাড়ি। ওই এলাকার ১০ জন বাসিন্দা ও দলীয় নেতা–কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাহমুদুলের এক চাচাতো ভাই বিএনপির নেতা ছিলেন। তিনি দেশের বিভিন্ন স্থানে মুঠোফোন কোম্পানির টাওয়ার স্থাপনের কাজ পান। সেই কাজের তদারকি করতে গিয়ে মাহমুদুলের হাতে বেশ কিছু টাকা আসে। সেটা ২০০৭ সালের কথা। ২০১১ সালে তাঁর আরেক চাচাতো ভাই পুলিশের বড় কর্মকর্তা হন। তখন থেকেই ধীরে ধীরে তাঁর আধিপত্য বাড়তে থাকে।
কামালের বার্ত্তী বাজারে মো. মাসুদ নামের এক ব্যক্তি প্রথম আলোকে বলেন, মাহমুদুলের উত্থানের প্রথম সিঁড়ি ছিল পুলিশের ওই কর্মকর্তা। ভাই পরিচয় দিয়ে পুরো সাধুরপাড়া দাপিয়ে বেরিয়েছেন তিনি।
আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মী জানান, ২০০০ সালের দিকে মাহমুদুল জাতীয় পার্টিতে সক্রিয় ছিলেন। ২০১১ সালে আওয়ামী লীগের নানা কর্মসূচিতে অংশ নিতে শুরু করেন। ২০১৪ সালে সাধুরপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে পেয়ে যান। বহিষ্কারের আগপর্যন্ত টানা ৯ বছর পদটি আগলে ছিলেন। ২০১১ সালে প্রথম ইউপি নির্বাচনে অংশ নেন মাহমুদুল। সেবার পরাজিত হন। ২০১৬ সালে আবারও অংশ নিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০২২ সালেও নৌকা প্রতীকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি।
সাধুরপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. বজলুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাঁকে আমি অনেক পরামর্শ দিয়েছি। বলতাম, দেখো তুমি বড় হয়েছ, মানুষের ভালোবাসা পেতে হলে অনেক সময় ছোটও হতে হয়। কিন্তু কখনো এসব পরামর্শ নিতেন না তিনি।’
প্রথম যখন ওই চেয়ারম্যান ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী হন, তখন ভোটে ওই পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ওই চেয়ারম্যানের দাপুটে জীবন বা ত্রাসের রাজত্বের বিষয়ে কখনো কেউ কোনো অভিযোগ করেনি। বিষয়টি আমরা জানতাম না
বাড়িতে ঝুলছে তালা
কামালের বার্ত্তী বাজার থেকে দক্ষিণ পাশে মাহমুদুলের আধপাকা বাড়ির প্রতিটি ঘরে তালা ঝুলছে। উঠানে গোল একটি বৈঠকখানা। মাঝবয়সী এক নারীকে পাওয়া গেল। অনেক পীড়াপীড়ির পর জানা গেল, তিনি মাহমুদুলের চাচাতো ভাইয়ের স্ত্রী হাসেমা বেগম। তিনি বলেন, সাংবাদিক নিহত হওয়ার পর থেকে এই বাড়ির সবাই পলাতক। মাহমুদুলকে ভালো মানুষ দাবি করে তিনি বলেন, এখন একটা বিপদে পড়ছে। তাই সবাই নানা কথা বলছে।
গত রোববার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সাধুরপাড়া ইউনিয়নের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর এই প্রতিনিধির। কামালের বার্ত্তী বাজারে মাহমুদুলের তিনতলাবিশিষ্ট একটি বিপণিবিতান আছে, নাম হাবিবা সুপারমার্কেট। দোতলা পর্যন্ত দোকান হিসেবে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। তিনতলায় তাঁর ব্যক্তিগত কার্যালয়। ওই বিপণিবিতানের পাশেই ছয় মাস আগে ২২ শতাংশ জমি কিনেছেন সাবেক এই চেয়ারম্যান। সেখানে আধপাকা পাশাপাশি দুটি বিবণিবিতান করেছেন। ওই জমির মধ্যেই আরও একটি দোতলা বিপণিবিতান নির্মাণাধীন।
তাঁরা সবাই এলাকায় দল বেঁধে চলাফেলা করতেন এবং মাহমুদুলের হয়ে নানা কাজ করে দিতেন বলে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
বকশীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. ইসমাইল হোসেন তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রথম যখন ওই চেয়ারম্যান ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী হন, তখন ভোটে ওই পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ওই চেয়ারম্যানের দাপুটে জীবন বা ত্রাসের রাজত্বের বিষয়ে কখনো কেউ কোনো অভিযোগ করেনি। বিষয়টি আমরা জানতাম না।’
বকশীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই চেয়ারম্যানের নামে তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীকে নির্যাতনের একটি অভিযোগ তদন্তাধীন। এ ছাড়া তাঁর নামে আর কোনো মামলার তথ্য এ মুহূর্তে আমাদের কাছে নেই।’ তাঁর চাচাতো ভাই পুলিশের একজন বড় কর্মকর্তা ছিলেন, সেই দাপটে পুলিশের সঙ্গে তাঁর সখ্য ছিল—স্থানীয় মানুষের এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের কোনো তথ্যও আমাদের কাছে নেই।’
সন্ত্রাসী বাহিনী
মাহমুদুলের সন্ত্রাসী বাহিনীর নেতৃত্ব ছিলেন তাঁতী লীগের সাধুরপাড়া ইউনিয়ন শাখার সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ইউনিয়ন যুবলীগের সদস্য মো. মনিরুজ্জামান, তাঁতী লীগের সদস্য জাকিরুল ইসলাম, বকশীগঞ্জ উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের পৌর শাখার তথ্য ও সাহিত্যবিষয়ক সম্পাদক মো. মিলন মিয়া, ইউনিয়ন যুবলীগের কর্মী গোলাম কিবরিয়া, উপজেলা তাঁতী লীগের সভাপতি শহিদুর রহমান, নামাপাড়া এলাকার মো. তোফাজ্জল ও একই এলাকার আয়নাল হক, সাধুরপাড়া এলাকার মো. কফিল উদ্দিন, কুতুবের চর গ্রামের মো. ফজলু মিয়া, মৌল্লাপাড়া এলাকার মো. মুকবুল ও সরদারপাড়ার মো. ওহিদুজ্জামান। মাহমুদুলসহ এই ১৩ জন বর্তমানে কারাগারে।
মাহমুদুলের সন্ত্রাসী বাহিনীতে আরও ছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সহপ্রচার ও প্রকাশনাবিষয়ক সম্পাদক রাকিব বিল্লাহ, সাধুরপাড়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি গাজী আমর আলী, উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী ইসমাইল হোসেন, উপজেলা যুবলীগের সদস্য মো. খন্দকার শামীম, যুবলীগ কর্মী শেখ ফরিদ, ছাত্রলীগ কর্মী ওমর ফারুক, ইউনিয়ন তাঁতী লীগের সদস্য রুবেল মিয়া, সাধুরপাড়া তাঁতী লীগের সহসভাপতি মো. আবু সাঈদ ও ৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য ইমান আলী। তাঁরা সবাই এলাকায় দল বেঁধে চলাফেলা করতেন এবং মাহমুদুলের হয়ে নানা কাজ করে দিতেন বলে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।