রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার বাকশিমইল ইউনিয়নের বিদ্যাধরপুর গ্রাম। এই গ্রামে রয়েছে মোহনপুর উপজেলা কেন্দ্রীয় মন্দির। এই মন্দির ঘিরে ৯৫টি হিন্দু পরিবারের বসবাস। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সন্ধ্যায় বিজয় মিছিল থেকে একদল লোক এই পাড়ায় হামলা করেন।
হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন জানিয়েছেন, তাঁদের ২৫টি বাড়িতে কমবেশি হামলা করা হয়েছে। মিছিল নিয়ে যাওয়ার সময় হামলাকারী ব্যক্তিরা সামনে যা পেয়েছেন, তাতেই লাঠি দিয়ে আঘাত করে ভাঙার চেষ্টা করেছেন। এদিকে হামলা শুরু হলে গ্রামের নারীরা ভয়ে ফসলের মাঠে পালিয়ে যান। আর যাঁরা যেতে পারেননি, তাঁরা বাইরের দরজা বন্ধ করে ভেতরে ছিলেন।
এ ঘটনার পর থেকে বিদ্যাধরপুর হিন্দুপাড়ার মানুষেরা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। পাড়ার ছেলেরা রাত জেগে মন্দির, বাড়িঘর ও দোকানপাট পাহারা দিচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে ১৪ আগস্ট রাতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে ওই পাড়া পরিদর্শনে আসেন। ইউএনও আতঙ্কগ্রস্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের ওপর আর হামলা হবে না বলে অভয় দিয়েছেন।
মোহনপুর থানা থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দক্ষিণে রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কের পূর্ব পাশে বিদ্যাধরপুর গ্রাম। মহাসড়ক থেকে হেরিং বন্ডের সড়ক চলে গেছে গ্রামের ভেতরে। সোজা দক্ষিণ দিকে চলে গেছে হিন্দুপাড়ার সড়ক। আর পূর্ব দিকের রাস্তা চলে গেছে মুসলমান পাড়ায়।
গতকাল বুধবার (২১ আগস্ট) সরেজমিন হিন্দুপাড়ায় ঢুকতেই মোড়ে কথা হয় গ্রামের দুই তরুণের সঙ্গে। ৫ তারিখে এখানে হামলা হয়েছে কি না, তা জানতে চাইলে রাকিবুল ইসলাম (২০) ও আকাশ (১৮) নামের ওই দুজন দাবি করেন, এ গ্রামে কিছুই হয়নি। একটি ভাঙা দোকান দেখিয়ে কবে ভাঙা হয়েছে, জানতে চাইলে তাঁরা বললেন, তাঁরা জানেন না। তবে পাশে বসা একজন লোক আস্তে করে বলেন, ‘ভাঙচুর দিবসে’ দোকানটি ভাঙা হয়েছে।
হিন্দুপাড়ার বাসিন্দারা জানান, ৫ আগস্ট সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে একদল লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে হিন্দুপাড়ায় বাড়ি বাড়ি ঢুকে হামলা চালাতে থাকেন। ৩০–৪০ মিনিটব্যাপী এ হামলা চলে। এ সময় বিদ্যুৎ ছিল না। কোনো স্লোগান দেননি হামলাকারীরা। হিন্দুপাড়ার একদিক দিয়ে ঢুকে আধা ঘণ্টাব্যাপী ভাঙচুর চালিয়ে অন্যদিক দিয়ে বেরিয়ে যান তাঁরা। হামলাকারী ব্যক্তিদের ঠেকাতে গেলে পিটিয়ে সুকুমার প্রামাণিক (৪৫) নামের একজন শিক্ষকের হাত ভেঙে দেন তাঁরা। তিনি উপজেলার আমরাইল উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক। গতকাল মঙ্গলবার তাঁর হাতে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। আজ বাড়িতেই ছিলেন। বাঁ হাতে ব্যান্ডেজ জড়ানো। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ৫ আগস্ট সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার পর গ্রামের ছেলেপেলে লাঠিসোঁটা নিয়ে তাঁর বাড়িতে হামলা চালাতে আসেন। তিনি বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না, এই ছেলেরা তাঁর ওপর হামলা করতে পারেন। গ্রামের হিন্দু-মুসলমান সবাই শিক্ষক হিসেবে তাঁকে সম্মান করেন। দেখা হলে সবাই তাঁকে সালাম দেন। সবার সঙ্গে তাঁর ভালো সম্পর্ক। তাঁদের যেকোনো ব্যাপারে তিনি সহযোগিতা করেন। সেই সাহস থেকেই হামলা ঠেকাতে তিনি এগিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা এসব করছ কেন?’ ওই মিছিলে তাঁর দুজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুও ছিলেন। তাঁরা বারণ করতে করতেই ছেলেরা লাঠি নিয়ে তাঁর ওপর হামলা করেন। তিনি হাত দিয়ে ঠেকাতে গেলেই তাঁর বাঁ হাতে আঘাত লাগে। হাসপাতালে গিয়ে এক্স-রে করে দেখেন হাতটা ভেঙে গেছে।
পাড়ার বাসিন্দা ভীমনগর হাইস্কুলের শিক্ষক শ্যামল কুমারের বাড়িতেও সেদিন হামলা হয়েছে। তাঁর ঘরের টিনের চালা ভাঙচুর করা হয়েছে। শ্যামল কুমারকে বাড়িতে পাওয়া গেল না। তাঁর স্ত্রী সুচিত্রা রানী বলেন, ‘ওরা যখন বাড়ির গেট ভাঙার চেষ্টা করে, তখন ভেতরে আমাদের প্রায় স্ট্রোক হওয়ার মতো অবস্থা।’
মোহনপুর কলেজের শিক্ষক ববিন কুমার সরকার ও তাঁর ভাই বিপুল কুমার সরকারের বাড়ির টিনের চালাও ভাঙচুর করা হয়েছে। বাড়ির দুটি জানালা ও শৌচাগারের পাইপ লাঠির আঘাতে ভাঙা হয়েছে। বিপুল কুমারের স্ত্রী পপি রানী সরকার বলেন, তাঁরা বাইরের গেট বন্ধ করে ভেতরে ছিলেন। হামলাকারী ব্যক্তিরা চেষ্টা করেও দরজা ভাঙতে পারেননি।
দেখা যায়, বিশ্বজিৎ প্রামাণিকের বাড়ির জানালার থাই গ্লাস ভেঙেছে। পানির ট্যাংকও ভেঙে ফেলা হয়েছে। আশুতোষ প্রামাণিকের বাড়ির জানালার দুটি থাই গ্লাস ভাঙচুর করা হয়েছে। তার মধ্যে একটি মেরামত করা হয়েছে। তাঁর স্ত্রী বলেন, একটি মেরামত করতেই ৩ হাজার ৩০০ টাকা খরচ হলো।
উপেন প্রামাণিকের গরুর ঘরের চালা ভাঙচুর করা হয়েছে। রাস্তার পাশে উপেন একটি দোকান করেছিলেন। সেটিও ভাঙচুর করা হয়েছে। উপেনের স্ত্রী আরতি প্রামাণিক বলেন, দোকানে তখনো মালামাল তোলা হয়নি। এই অবস্থায় হামলা করে দোকানটি ভাঙচুর করা হয়েছে। দোকানটি এখন ওভাবেই পড়ে রয়েছে। তাঁরা চালু করার সাহস পাচ্ছেন না।
হামলাকারী ব্যক্তিরা সুদর্শন চন্দ্র সরকারের বাড়ির জানালার গ্লাস ভাঙচুর করেছেন। সুদর্শন বলেন, সেদিন বাড়িতে কোনো ছেলেমানুষ ছিলেন না। মেয়েরা বাইরের দরজা বন্ধ করে ভেতরে ছিলেন। তাঁরা দরজা ভাঙার চেষ্টা করেছেন। একপর্যায়ে না পেরে জানালার থাই গ্লাস ও বিদ্যুতের মিটার ভেঙে চলে যান। এ ছাড়া দীপক সরকারের বাড়ির তিনটি জানালার গ্লাস ভাঙচুর করা হয়েছে। সেগুলো ওভাবেই রয়েছে। নারায়ণ সরকারের বাড়ির বারান্দার চালা, অজিত সরকারের দোকান, পরশুরাম প্রামাণিকের বাড়ির দুটি বারান্দার টিনের চালা, নারায়ণ প্রামাণিকের বাড়ির বারান্দার চালা, সুষেন প্রামাণিকের বাড়ির টিনের চালা ও শৌচাগারের পাইপ, অসিত কুমার সরকারের বাড়ির জানালা ভাঙা ও রতন প্রামাণিকের বাড়ির জানালায় লাঠি দিয়ে বাড়ি দেওয়া হয়েছে। এর কোনোটি ভেঙে গেছে, আবার কোনোটি দুমড়েমুচড়ে রয়েছে।
বিনয় প্রামাণিকের বাড়ির বারান্দার চালা ভাঙচুর করা হয়েছে। বৃষ্টি ঠেকাতে এখন তার ওপর পলিথিন দিয়ে রাখা হয়েছে। অবিনাশ সাহার বাড়ির জানালার গ্লাস, রান্নাঘরের চালা ও ঘরের ভেন্টিলেটর ভাঙচুর করা হয়েছে। অবিনাশের স্ত্রী মলিনা সাহা বলেন, এই বাড়ির অর্ধেক তাঁর দেবর নিতাই চন্দ্র সাহার। দুই বাড়িরই জানালার কাচ ভাঙা হয়েছে। হামলার সময় তাঁরা ভেতরে দরজা বন্ধ করে ছিলেন। হামলাকারী ব্যক্তিরা দরজা ভাঙার চেষ্টাও করেছেন। রাস্তার ধারেই ছিল অজিত সরকারের চায়ের দোকান। দোকানের চালা ও মালামাল সব ভাঙচুর করা হয়েছে।
মোহনপুর থানায় গিয়ে জানা যায়, বিদ্যাধরপুর হিন্দুপাড়ার কোনো মানুষই এই হামলার ব্যাপারে মামলা করতে আসেননি। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হরিদাস মণ্ডল গ্রাম পরিদর্শন করেছেন। সেখানেই পাওয়া গেল উপজেলার মৌগাছি ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইউনুস আলীকে। তিনি বললেন, এটা মানুষের বহুদিনের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।
জানতে চাইলে মোহনপুরের ইউএনও আয়শা সিদ্দিকা প্রথম আলোকে বলেন, ১৪ আগস্ট দিবাগত রাত ১২টার দিকে তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে বিদ্যাধরপুর গ্রামের কেন্দ্রীয় মন্দিরের সামনে গিয়েছিলেন। গ্রামের সবাই ওই রাতে মন্দির পাহারা দিচ্ছিলেন। তিনি তাঁদের অভয় দিয়ে এসেছিলেন যে গ্রামে আর এ ধরনের কোনো হামলার ঘটনা ঘটবে না। এরপর ১৬ আগস্ট বিকেলে তিনি উপজেলা বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর স্থানীয় নেতাদের নিয়ে বসেছিলেন। সেখানে বিদ্যাধরপুর গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনও ছিলেন। তাঁদের সামনেই স্থানীয় নেতারা নিশ্চয়তা দেন যে এ ধরনের কোনো ঘটনা আর ঘটবে না। বিষয়টি তাঁরা দেখবেন। এরপর আর এমন কোনো ঘটনা গ্রামে ঘটেনি।