দাদার পর বাবাও ‘হত্যার’ শিকার, কিশোরের কাঁধে সংসারের ভার
পিরোজপুরের আদালত প্রাঙ্গণ, বঙ্গমাতা সেতু ও আশপাশ এলাকায় সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বাদাম বিক্রি করে মো. নাঈম (১৪) নামের এক কিশোর। এক বছর ধরে নাঈমের কাঁধে পরিবার দায়িত্বভার পড়েছে। প্রথমে মুদিদোকানে কাজ নেয়। পরে সে কাজ ছেড়ে বাদাম বিক্রি শুরু করে। এখন বাদাম বিক্রি থেকে যা আয় হয়, তা দিয়ে পাঠিয়ে দেয় মায়ের কাছে।
মো. নাঈম পিরোজপুর পৌরসভার মণ্ডলপাড়া মহল্লায় মো. মামুন নামে তার এক মামার কাছে থাকে। মামুন নাঈমের মা নার্গিস বেগমের খালাতো ভাই। নাঈমের বাড়ি বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার পাদ্রি শিবপুর গ্রামে। ছয় মাস ধরে নাঈম পিরোজপুর শহরে বাদাম বিক্রি করছে। এর আগে সে একটি মুদিদোকানে তিন হাজার টাকা বেতনে কাজ করত।
প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ টাকা লাভ হয়। থাকাখাওয়া বাবদ মামা মামুনকে কিছু টাকা দেয়। বাকি টাকা মাকে পাঠায়।
নাঈমের মা নার্গিস বেগম বলেন, নাঈমের দাদা আবদুস সোবাহান গরুর ব্যবসা করতেন। আট বছর আগে আবদুস সোবাহানকে হত্যা করে টাকা ছিনতাই করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় মামলা করেন নাঈমের বাবা মো. শামীম। ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর ওই হত্যা মামলার আসামিদের হাতে খুন হন শামীম। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি শামীম নিহত হলে দুই ছেলে ও শাশুড়িকে নিয়ে বিপাকে পড়েন তিনি। বাসাবাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে সংসার চালাতেন। অভাবের সংসারে চারজনের ভরণপোষণ ও দুই ছেলের পড়াশোনা চালাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছিল তাঁর। এমন পরিস্থিতিতে এক বছর আগে বড় ছেলে নাঈমের পড়াশোনা বন্ধ করে এক মুদিদোকানে মাসিক তিন হাজার টাকা বেতনে কাজে নিয়ে দেন। ছয় মাস আগে সেই কাজ ছেড়ে নাঈম বাদাম বিক্রি শুরু করেছে। বাদাম বিক্রি করে সব খরচের পর নাঈম তাঁকে (নার্গিসকে) প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকা দেয়। ছেলের পাঠানো টাকা আর ঝিয়ের কাজ করে জীবন কাটছে তাঁর।
বাকেরগঞ্জ উপজেলার পাদ্রি শিবপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য মো. জসিম উদ্দিন খান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, আবদুস সেবাহান খুন হয়েছিলেন। তাঁর ছেলে শামীমের মৃত্যু সড়ক দুর্ঘটনায় হয়েছিল বলে শুনেছেন। তবে শামীমের মৃত্যুর ঘটনায় হত্যা মামলা হয়েছিল।
সম্প্রতি পিরোজপুর সদর উপজেলার কচা নদীর ওপর নির্মিত বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব অষ্টম বাংলাদেশ–চীন মৈত্রী বঙ্গমাতা সেতুতে বাদাম বিক্রির করার সময় কথা হয় নাঈমের সঙ্গে। নাঈম বলে, রোববার থেকে বৃহস্পতিবার সকাল নয়টা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত পিরোজপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালত প্রাঙ্গণে বাদাম বিক্রি করে। এরপর বেলা ৩টা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত বঙ্গমাতা সেতুতে বাদাম বিক্রি করে। শুক্র ও শনিবার বঙ্গমাতা সেতুতে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বাদাম বিক্রি করে থাকে। এতে প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ টাকা লাভ হয়। থাকাখাওয়া বাবদ মামা মামুনকে কিছু টাকা দেয়। বাকি টাকা মাকে পাঠায়।
নার্গিস বেগম আরও বলেন, অভাবের কারণে নাঈমের পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে হয়েছে। এই বয়সে তাঁর ছেলে আয় করে সংসারে দিচ্ছে। ওর দাদার পর বাবা খুন হওয়ায় ছেলে বড় না হওয়া পর্যন্ত এলাকার বাইরে রাখতে চান। ছোট ছেলে আজাহারকে নিয়েও ভয়ে থাকেন। একটু বড় হলেও আজাহারকেও দূরে পাঠিয়ে দেবেন। তবে আজাহারকে পড়াশোনা করানোর ইচ্ছে আছে।
মো. মামুন বলেন, ‘ছয় মাস আগে নাঈমকে তাঁর মা আমার কাছে পাঠিয়ে দেন। এরপর আমি ওকে আমার কাছে রেখে বাদাম বিক্রি করার ব্যবস্থা করে দিই। নাঈমের নিরাপত্তা নিয়ে ওর মা চিন্তিত ছিলেন। এ জন্য বাড়ি থেকে দূরে আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন।’