ছয় বছর বয়সী আলিনা ছিল সবার আদরের। দুই বছর আগে ফুটফুটে আলিনাকে হারায় পরিবার। এখনো এক মুহূর্তের জন্য তাকে ভুলতে পারেননি পরিবারের সদস্যরা। আলিনার ছবি সঙ্গে রাখেন বাবা সোহেল রানা।
আজ আলিনার কথা তুলতেই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘মেয়ের ছবি দেখি আর চোখের পানি ঝরে।’ এ কথা বলে আর তেমন কিছু বলতে পারলেন না। কথা যেন থেমে যায়।
চট্টগ্রাম নগরের ইপিজেড থানার বন্দরটিলা এলাকার সোহেল রানার মেয়ে আলিনা ইসলাম আয়াতের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী কাল শুক্রবার। ২০২২ সালের এই দিনে বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয় আলিনা। ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণের জন্য অপহরণ করা হয় তাকে। তবে মুক্তিপণ আদায়ের সম্ভাবনা নেই দেখে সেদিনই তাকে হত্যা করেন অপহরণকারী। হত্যার পর ফুটফুটে আলিনাকে কেটে ছয় টুকরা করেন ২০ বছর বয়সী তরুণ আবির আলী।
খুনি আবির আলিনাদের বাসায় ভাড়া থাকতেন। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও আবিরের সখ্য ছিল। এ কারণে আবির এমন কাজ করতে পারেন, তা ধারণাও করতে পারেননি আলিনার মা–বাবা। এমন নৃশংসতার কথা ভুলতেও পারছেন না তাঁরা।
আলিনা হত্যা মামলা বর্তমানে প্রথম অতিরিক্ত চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ কামাল হোসেন শিকদারের আদালতে বিচারাধীন। সেখানে সাক্ষ্য চলছে। চলতি মাসে গত বুধবার আলিনার বাবা মামলার বাদী সোহেল রানার সাক্ষ্য নেন আদালত। ২৮ নভেম্বর তাঁকে জেরার দিন ধার্য রয়েছে।
২০২২ সালের ১৫ নভেম্বর আলিনা নিখোঁজ হয়। ইপিজেড থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হলেও কোনো কিনারা হয়নি। পরে আলিনার বাবা পিবিআইয়ের কাছে যান। তারা ছায়া তদন্ত শুরু করে।
১০ দিন পর পিবিআই জানায়, মুক্তিপণ আদায়ের জন্য আলিনাকে অপহরণ করেছিলেন তাদের বাসার ভাড়াটে আবির। আবিরের বাবা ভ্যানচালক আজহারুল ইসলাম। তাঁরা আলিনাদের বাসায় ভাড়া থাকতেন।
২৫ নভেম্বর আবিরকে পিবিআই গ্রেপ্তারের পর তিনি হত্যার কথা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। ১১ মাস তদন্ত শেষে গত বছরের ১০ অক্টোবর পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো পরিদর্শক মনোজ দে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। এতে মো. আবির ও তাঁর বন্ধু ১৭ বছর বয়সী এক কিশোরকে (কিশোর বলে নাম উল্লেখ করা হলো না) আসামি করা হয়। আসামিদের মধ্যে আবির কারাগারে। বাকিরা জামিনে রয়েছেন।
পিবিআইয়ের দেওয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়, জবানবন্দিতে আবির ভারতীয় সিরিয়াল দেখে এমন পরিকল্পনা করার কথা জানিয়েছেন। আবির পিবিআইকে বলেন, শিশু আলিনাকে হত্যার পর আবির লাশ তাঁদের ভাড়া বাসায় লুকিয়ে রেখেছিলেন। এরপর নিজেই আলিনার মা-বাবার সঙ্গে মিলে আলিনাকে খুঁজতে থাকেন। এর আগেও তিনি কয়েকবার আলিনাকে অপহরণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। বাসার আশপাশে লোকজন থাকায় কিছু করতে পারেননি। হঠাৎ বড়লোক হওয়ার ইচ্ছা জাগে আবির আলীর। এ জন্য অপরাধবিষয়ক ভারতীয় সিরিয়াল ‘ক্রাইম পেট্রলে’ আসক্ত আবির শিশু আলিনাকে অপহরণের পর ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায়ের পরিকল্পনা করেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী আলিনাকে অপহরণও করেন আবির। কিন্তু মুক্তিপণ চাইতে গিয়ে বাধে বিপত্তি। যে সিম ব্যবহার করে আবির আলিনার বাবাকে ফোন করতে চেয়েছিলেন, সেটি ব্লক করা ছিল। পরিচিত নম্বর থেকে ফোন করলে পুলিশের হাতে ধরা পড়বেন এমন ভয় ছিল তাঁর। তাই মুক্তিপণ আদায়ের পরিকল্পনা ভেস্তে যেতেই শ্বাসরোধে হত্যার পর বস্তায় ভরে শিশুটির লাশ ভ্যানে নিয়ে যান আরেক বাসায়। পরে সেখানে কেটে ছয় টুকরা করে কিছু সাগরে আর কিছু খালের পাশে ফেলে দেন তিনি।
শুধু বাবা নন, আলিনার মা সাহেদা আক্তারও মেয়ের কথা ভেবে সারাক্ষণ কাঁদেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সোনার টুকরা মেয়েকে হারিয়েছি দুই বছর। এক মুহূর্তেরও জন্যও তাকে ভুলতে পারিনি। পুরো বাসা মাতিয়ে রাখত সে। এখনো বাসায় রেখে দিয়েছি তার খেলনা, কাপড়চোপড়। সেগুলো দেখে দিন কাটাই।’
জানতে চাইলে মামলাটি পরিচালনাকারী সরকারি কৌঁসুলি জালাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, এটি চাঞ্চল্যকর মামলা। সাক্ষী দ্রুত শেষ করার জন্য রাষ্ট্রপক্ষ তৎপর রয়েছে। এ জন্য ১৫ দিন অন্তর মামলার তারিখ রাখা হচ্ছে।
আসামির ফাঁসি দ্রুত কার্যকরের জন্য মামলার বিচার দ্রুত শেষ করার দাবি জানান আলিনার বাবা সোহেল রানা। তিনি বলেন, এতে অপরাধীরাও বুঝতে পারবে যে অপরাধ করে পার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আর কোনো মা–বাবার বুক যাতে খালি না হয়।