মহাসড়কের পাশে পড়ে আছে কোরবানির পশুর চামড়া
ঈদুল আজহার দিন থেকে গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলা সদরে ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের পাশে কয়েক শ কোরবানির পশুর চামড়া পড়ে আছে। রোদ-বৃষ্টিতে চামড়া পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। দুর্গন্ধে পথচারীরা নাক চেপে চলাচল করছেন। পড়ে থাকা চামড়া অপসারণে কেউ উদ্যোগ না নেওয়ায় স্থানীয় লোকজন বিড়ম্বনায় পড়েছেন।
ক্ষুদ্র চামড়া ব্যবসায়ীরা বলেন, এবার গাইবান্ধায় পশুর চামড়ার দাম অনেকটা কম। বাজারে চামড়ার সরবরাহ প্রচুর। কিন্তু ক্রেতা নেই। উপরন্তু ধারদেনা করে অনেকে চামড়ার ব্যবসায় লগ্নি করেছেন। সেই চামড়া তাঁরা বিক্রি করতে না পারায় মহাসড়কের পাশে ফেলে রেখে গেছেন।
গাইবান্ধা জেলা শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে পলাশবাড়ী উপজেলা। উপজেলা সদরের কালীবাড়ি এলাকায় পলাশবাড়ী চামড়ার হাট। হাটটি ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক ঘেঁষে গড়ে উঠেছে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা এ হাটে কোরবানির পশুর চামড়া বেচাকেনা করতে আসেন।
বৃহস্পতিবার সকালে সরেজমিনে দেখা গেছে, পলাশবাড়ী চামড়ার হাটের ভিন্ন চিত্র। হাটের পাশে উপজেলা সদরের গিরিধারিপুর এলাকায় ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের পাশে যত্রতত্র গরু, ছাগল ও ভেড়ার চামড়া পড়ে আছে। বিক্রি না হওয়ায় ক্ষুদ্র চামড়া ব্যবসায়ীরা বস্তায় ভরে ও খোলা অবস্থায় এসব চামড়া ফেলে রেখে গেছেন। রোদ ও বৃষ্টিতে পড়ে থাকা চামড়া পচন ধরেছে। মশা-মাছি ও দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। ওই এলাকায় যাতায়াত কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক দিয়ে হাজার হাজার লোকজন চলাচল করছে। ওদিকে স্থানীয় পাইকারেরা চামড়া নিয়ে বসে আছেন। যাঁরা চামড়া কিনেছেন, তাঁরা তাতে লবণ দিচ্ছেন।
গিরিধারিপুর এলাকায় মহাসড়কের পাশের চায়ের দোকানি আরিফ মিয়া বলেন, ঈদের দিন বিকেল থেকে ক্ষুদ্র চামড়া ব্যবসায়ীরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে চামড়া কেনেন। তাঁরা এ হাটে চামড়া বিক্রি করতে আনেন। কোরবানির চামড়া নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেন। কেউ চামড়া কিনতে আসেননি। তাই বাধ্য হয়ে মহাসড়কের পাশে চামড়া ফেলে রেখে চলে যান। কয়েক দিন ধরে পড়ে থাকায় চামড়া পচে গেছে। মশা-মাছি ভনভন করছে। নাক-মুখ চেপে চলাচল করতে হচ্ছে।
একই এলাকার সাধারণ ব্যবসায়ী লিটন মিয়া বলেন, জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা কোরবানির কাঁচা চামড়া নিয়ে এখানে আসেন। পশুর হাটের জায়গা ভেতরে হলেও ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক ঘেঁষে বসেন তাঁরা। চামড়া বিক্রি না হওয়ায় তাঁরা মহাসড়কের পাশে ফেলে রেখে গেছেন। ঈদের দিন থেকে, অর্থাৎ চার দিন ধরে মহাসড়কের পাশে চামড়া পড়ে থেকে পরিবেশ দূষিত করছে। কিন্তু পৌরসভা কর্তৃপক্ষ বা পাইকারেরা এসব চামড়া পরিষ্কার করছেন না।
একই এলাকার গালা মালের দোকানি মমিনুল ইসলাম(৩২) বলেন, ঈদের পরের দিন লোকজন চামড়া নিয়ে আসছিলেন। পরে সেগুলো বিক্রি হয়নি। ফলে তাঁরা চামড়া ফেলে রেখে কৌশলে চলে যান। তিনি বলেন, অবিক্রীত পশুর চামড়া ফেলে রাখায় দুর্গন্ধে এলাকা দিয়ে যাতায়াত করা যায় না। লোকজন চামড়া রেখে চলে গেছেন, এখন সাধারণ মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। হাট ইজারাদার ও পৌরসভা এলাকাটি পরিষ্কার করার উদ্যোগ নেই।
পলাশবাড়ী চামড়া ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করার দায়িত্ব পৌরসভার কর্মীদের। প্রতি সপ্তাহে বুধবার হাট বসে। সেটার জন্য নির্দিষ্ট জায়গা রয়েছে। কিন্তু মহাসড়কের পাশে কারা এসব চামড়া ফেলেছেন, তা কেউ জানেন না।
জানতে চাইলে পলাশবাড়ী পৌরসভার মেয়র গোলাম সরওয়ার বলেন, বিষয়টি জানার পর চামড়াগুলো সরানোর জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এলাকাটি পরিষ্কার করা হবে।
পলাশবাড়ী চামড়া ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আরও বলেন, ট্যানারিমালিকদের কাছে গত বছরের প্রায় ৫ কোটি টাকা স্থানীয় ১০-১২ জন পাইকারের পাওনা রয়েছে। প্রতিবছর ঢাকা থেকে অ্যাপেক্স, এক্সজিম, ও বিএলসি ট্যানারির মালিকেরা চামড়া কিনতে আসেন। এবার এখন পর্যন্ত তাঁরা আসেননি। এ ছাড়া ২০১৪ সাল থেকে ঢাকার ট্যানারিশিল্পে পানি শোধনাগারের ব্যবস্থাসহ নানা পরিবেশগত সমস্যার কারণে ইউরোপ এ দেশের চামড়া কিনছে না। কেবল কম দামে চীন কিনছে। আগামী বুধবার তাদের আসার কথা। তাদের চাহিদার ওপর চামড়ার বাজার অনেকটা নির্ভর করছে। তিনি বলেন, ‘স্থানীয় পাইকারেরা এ পর্যন্ত ৪০–৫০ হাজার গরুর চামড়া কিনে লবণজাত করে রেখেছেন। সেগুলো নিয়েই আমরা বিপাকে আছি।’
গাইবান্ধা সদর উপজেলার পুলবন্দি গ্রামের ক্ষুদ্র চামড়া ব্যবসায়ী হীরালাল বলেন, ‘প্রতিবছর ঈদের দিন থেকে গ্রামে গ্রামে ঘুরে চামড়া কিনি। পরে পলাশবাড়ী হাটে পাইকারদের কাছে সেই চামড়া বিক্রি করি। এবার চামড়া বিক্রি করতে পারিনি। ঈদের পরদিন পলাশবাড়ী হাটে চামড়া নিয়ে বসে থাকলেও কেউ কেনা দামও বলেননি। দুপুরের পর বাধ্য হয়ে ৪০ হাজার টাকার চামড়া ৬ হাজার টাকা লোকসানে বিক্রি করেছি। অনেকে চামড়া মহাসড়কে ফেলে রেখে গেছেন।’
গত বুধবার ৫০ হাজার টাকার চামড়া কিনে ওই হাটে বিক্রি করতে গিয়েছিলাম। সকাল আটটা থেকে বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি, কেউ দাম বলেনি।
এ হাটে আসা একই উপজেলার কূপতলা গ্রামের ক্ষুদ্র চামড়া ব্যবসায়ী লালচান বলেন, ‘গত বুধবার ৫০ হাজার টাকার চামড়া কিনে ওই হাটে বিক্রি করতে গিয়েছিলাম। সকাল আটটা থেকে বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি, কেউ দাম বলেনি। পাইকারেরা বলছেন, চামড়া কিনে কী করব? ঢাকা থেকে ট্যানারির মালিকেরা আসছেন না। আমরা বিক্রি করব কোথায়? তাই দুপুরের পর বাধ্য হয়ে চামড়া বাড়ি নিয়ে গেছি।’
চামড়া ব্যবসায়ীরা জানান, সরকার এবার ঢাকার বাইরে প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ৫০ টাকা ও ছাগলের চামড়া ২০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা গ্রাম ঘুরে প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ৬০-৬৫ টাকা ও ছাগলের চামড়া ২৫-৩০ টাকা দামে কিনেছেন।
গাইবান্ধা শহরের চামড়া ব্যবসায়ী আরশাদ আলী বলেন, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে চামড়া কিনেছেন। ফলে তাঁদের কাছ থেকে বেশি দামে চামড়া কিনতে মহাজনেরা আগ্রহী হচ্ছেন না।