‘আমি কোনো রাজনীতির সঙ্গে নাই, তবু আমার ২২ বছরের অর্জন ২২ মিনিটে শেষ’
‘অভাব–অনটনের মধ্যে বড় হইছি। আমার বাবা ছিলেন কৃষক, আমার যখন দুই বছর বয়স, মারা যান। বাবার কোনো স্মৃতিও মনে নাই। অভাবের কারণে পড়াশোনাও তেমন করতে পারি নাই। ছোটবেলা থেকেই উপার্জন করতে শুরু করছি। অনেক কষ্ট করে ২২ বছরে যা অর্জন করছিলাম, রাজনীতির ২২ মিনিটের ঝড়ে সব শেষ হয়ে গেছে। আমি রাজনীতি বুঝি না। কোনো রাজনীতির সঙ্গে নাই। তবু আমার সব শেষ হয়ে গেছে।’
আহাজারি করে কথাগুলো বলছিলেন আশরাফুল ইসলাম লস্কর (৪০) নামের এক ইলেকট্রনিকস পণ্যের ব্যবসায়ী। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার শাহবাজপুর গ্রামের মুসা লস্করের ছেলে তিনি। রাজনীতির পালাবদলে তাঁর ইলেকট্রনিকস পণ্যের শোরুমে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করার ফলে তিনি নিঃস্ব হয়ে গেছেন।
সরাইল উপজেলা সদরের হাসপাতাল মোড়ে একটি বহুতল ভবনের দ্বিতীয় তলায় আশরাফুলের বিক্রয়কেন্দ্র ছিল। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর বিকেলে হাজারো লোক বিজয় মিছিল বের করেন। আশরাফুল দোকান বন্ধ করে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে বিজয় মিছিল দেখছিলেন। বেলা প্রায় সাড়ে তিনটার দিকে মিছিল থেকে একদল লোক আশরাফুলের দোকানে হামলা চালায়। শাটার ভেঙে চলে লুটপাট। মিছিলের লোকজন যার যার মতো করে টিভি, ফ্যানসহ নানা পণ্য নিয়ে যায়। কয়েকজন ফ্রিজে আগুন ধরিয়ে দেয়। মুহূর্তের মধ্যে ‘রাজনীতির আগুনে’ পুড়ে সব শেষ হয়ে যায় আশরাফুল। দোকানের অদূরেই আশরাফুলের ভাড়া বাসা। ঘটনার পর দৌড়ে বাসায় গিয়ে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তাঁকে ঘিরে কান্নার রোল পড়ে যায়।
আংকেল, আমার আব্বুর তো কোনো দোষ নাই। আব্বুর সব শেষ। আমরা এখন কোথায় যামু? কী খামু?
আশরাফুল বলেন, ‘জীবন থেকে অভাব দূর করতে ১৮ বছর বয়সে বিদেশে গেছি। দেড় বছর পর মায়ের অসুখের খবরে দেশে ফিরে আসি। এসে মাকেও হারাই। পরে ঢাকায় ছোট্ট একটি ব্যবসা দিছিলাম। সুবিধা করতে পারি নাই। চলে আসি নিজ উপজেলায়। উপজেলা সদরের হাসপাতাল মোড়ে এক আত্মীয়ের সঙ্গে পার্টনারে ইলেকট্রনিকসের ব্যবসা দিই। পরে ২০১২ সাল থেকে আলাদা ব্যবসা শুরু করি। ব্যবসার পুঁজির জন্য পৈতৃক সূত্রে পাওয়া পাঁচ শতক বাড়িভিটা থেকে দুই শতক বিক্রি করে দিই। ব্যাংকঋণ নিই। এ ছাড়া এখনো প্রতিষ্ঠান আমার বকেয়া পায় ২৩ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে আমার ঋণ আছে ৩০-৩৫ লাখ টাকা। হাসপাতাল মোড়ে সরাইল-নাসিরনগর সড়কের পাশে ১ হাজার ১০০ বর্গফুটের শোরুমটিতে ওয়ালটনের প্রায় ৫০ লাখ টাকার মালামাল ছিল। ১০ লাখ টাকার ডেকোরেশন ছিল। ছিল ১৪-১৫ হাজার নগদ টাকা, পাসপোর্টসহ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। লুটপাটের পর সব পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।’
আশরাফুল আরও বলেন, ‘১০ বছর ধরে আমি কিস্তিতে পণ্য বিক্রি করতাম। অধিকাংশ ক্রেতা কিস্তিতে পণ্য কিনতেন। লোকজনের কাছে প্রায় ৩০ লাখ টাকা পাওনা আছে। পাওনাদারদের নাম-ঠিকানার সব তথ্য পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কার কাছে কত টাকা পাই সব লেখা ছিল। এগুলো আমার মনে নাই। পরিচিত কয়েকজনকে ফোন দিছিলাম। তাঁরা এখন ওয়ারেন্টি-গ্যারান্টি কার্ড চায়, টাকা না দিতে নানা টালবাহানা করছে।’
আশরাফুলের স্ত্রী রোজী বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনার পর তিন দিন তিনি (স্বামী) অসুস্থ ছিলেন। ঘটনার ৯ দিন পর আজ বুধবার আমরা প্রথম শোরুমে এলাম। সঙ্গে আমার এক মেয়ে আর একমাত্র ছেলেও আইছে। তিন মেয়ে আর এক ছেলেসহ ছয়জনের সংসার। নিজের ভিটেবাড়িতে কিছুই করা হয়নি। ভাড়া বাসায় থাকি। সন্তানেরা স্কুল–কলেজে পড়ে। তাদের লেখাপড়া আর সংসার কীভাবে চলবে। আমরা এখন পথের ফকির।’
কান্নাভেজা কণ্ঠে রোজী বেগম আরও বলেন, ‘বুঝতেছি না এখন আমরা কী করব, কোথায় যাব, কার কাছে বিচার দেব? কে আমাদের আশ্রয় দেবেন। ঋণ পরিশোধ করব কীভাবে। আমাদের নিজের একটি ঘরও নাই। কোথায় যাব, সন্তানদের কী হবে? কে দেবে আমার সন্তানদের আশ্রয়? বসতভিটা বিক্রি করেও ঋণ পরিশোধ করতে পারব না। কোথায় পাব এর প্রতিকার।’
আশরাফুলের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া একমাত্র ছেলে আতিকুর রহমান (১০) প্রথম আলোকে বলে, ‘আংকেল, আমার আব্বুর তো কোনো দোষ নাই। আব্বুর সব শেষ। আমরা এখন কোথায় যামু? কী খামু?’