দপ্তরে বসে সভা করেও সম্মানি পান যশোর শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা

যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডফাইল ছবি

যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের বয়স সংশোধনী কমিটির একটি সভা হয় গত বছরের ১৫ অক্টোবর। কমিটির সভাপতি হিসেবে সভায় সভাপতিত্ব করেন শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান আহসান হাবীব। ১৪ সদস্যের কমিটির মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আট সদস্য। এর মধ্যে বোর্ডের অভ্যন্তরীণ সদস্য ছিলেন পাঁচজন ও বহিঃস্থ সদস্য ছিলেন তিনজন। উপস্থিত সবাই চার হাজার টাকা করে সম্মানি পান।

এভাবে ‘সিটিং অ্যালাউন্স’ বাবদ প্রতি মাসে বোর্ডের কর্মকর্তারা কয়েক লাখ টাকা করে তুলে নিচ্ছেন। গত বছরের শেষ তিন মাসে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) বোর্ডের ১৬ কর্মকর্তা ৫ লাখ ২৩ হাজার টাকা সম্মানি পেয়েছেন বলে বোর্ডের নথি থেকে জানা গেছে। কার্যদিবসে কার্যালয় বসে বৈঠক করে ‘সম্মানি’ নেওয়াকে ‘অনৈতিক’ বিবেচনা করে তা বন্ধ রেখেছিলেন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান। তবে কর্মকর্তাদের দাবির মুখে বর্তমান চেয়ারম্যান তা আবারও চালু করেছেন।

এ বিষয়ে যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান মোল্লা আমির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার মনে হয়েছে, অভ্যন্তরীণ কর্মকর্তাদের সিটিং অ্যালাউন্স নেওয়াটা অনৈতিক। কারণ, সরকারি চাকরিজীবী হিসেবে ২৪ ঘণ্টাই আমার অফিশিয়াল ডিউটি। বোর্ডের প্রয়োজনে মিটিং–সিটিং করা লাগতেই পারে। নিজের চেয়ারে বসে অফিশিয়াল টাইমে মিটিং করে টাকা নেওয়াটা যৌক্তিক মনে হয়নি। এ কারণে আমি, এটা বাতিল করেছিলাম।’

শিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, বয়স সংশোধন, দরপত্র, পরীক্ষা, আপিল অ্যান্ড আর্বিট্রেশনসহ বিভিন্ন বিষয়ে বোর্ডের ১৮টি কমিটি রয়েছে। বোর্ডের চেয়ারম্যান, সচিব, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকসহ কয়েক কর্মকর্তা অধিকাংশ কমিটির সদস্য। এসব কমিটির সদস্যরা বৈঠক করে সম্মানি নিচ্ছেন।

শিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের শেষ তিন মাসে চেয়ারম্যান আহসান হাবীব ৬০ হাজার ৫০০ টাকা, সচিব এম আবদুর রহিম ৬৪ হাজার ৫০০ টাকা, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বিশ্বাস শাহীন আহম্মদ ৬৮ হাজার টাকা, কলেজ পরিদর্শক সমীর কুমার কুণ্ডু ৮২ হাজার টাকা, বিদ্যালয় পরিদর্শক সিরাজুল ইসলাম ৬২ হাজার টাকা, উপপরিচালক এস এম রফিকুর রহমান ৪৬ হাজার টাকা, প্রোগ্রামার জাকির হোসেন ৪০ হাজার টাকা, উপকলেজ পরিদর্শক মোদন মোহন দাস ৩০ হাজার টাকা বৈঠক সম্মানি পেয়েছেন। রেজিস্টার খাতায় স্বাক্ষর করে তাঁরা এই টাকা তুলে নেন। কমিটির বহিঃস্থ সদস্যরাও একইভাবে বৈঠকে উপস্থিত থাকার জন্য সম্মানি পেয়েছেন। চলতি বছরেও প্রতি মাসেই কর্মকর্তারা এ সম্মানি নিচ্ছেন।

বোর্ডের নথি থেকে জানা গেছে, গত ১১ অক্টোবর পূর্ণ কর্মদিবসের সকালে তিনটি দরপত্রের খাম খোলার জন্য দুই সদস্যবিশিষ্ট ই-টেন্ডার ওপেনিং কমিটির পরপর তিনটি বৈঠক হয় একই জায়গায়। ওই বৈঠকে উপস্থিত থাকা বোর্ডের প্রোগ্রামার মো. জাকির হোসেন বৈঠকপ্রতি দুই হাজার করে মোট ছয় হাজার টাকা সম্মানি হিসেবে তুলে নেন। গত ১৬ অক্টোবর পূর্ণ কর্মদিবসে ই-টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটির পরপর দুটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে উপস্থিত থাকা কলেজ পরিদর্শক সমীর কুমার কুণ্ডু ও প্রোগ্রামার জাকির হোসেন বৈঠকপ্রতি দুই হাজার করে মোট চার হাজার টাকা করে দুজনে তুলে নেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কলেজ পরিদর্শক সমীর কুমার কুণ্ডু প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিক্ষা বোর্ডের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী চেয়ারম্যান। তিনি সম্মানি গ্রহণের অনুমোদন দিয়েছেন বলে আমরা গ্রহণ করেছি। এ বিষয়ে তিনিই ভালো বলতে পারবেন।’ প্রোগ্রামার জাকির হোসেন বলেন, ‘ই-টেন্ডার ওপেনিং ও ই-টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটি দুটির সদস্য আমি। ওই কমিটির বৈঠকে উপস্থিত থেকে সম্মানি হিসেবে ওই টাকা গ্রহণ করেছি। অন্যরা নিয়েছে। আমিও নিয়েছি।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান আহসান হাবীব প্রথম আলোকে বলেন, অন্যান্য শিক্ষা বোর্ড ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন কমিটির বৈঠকে সিটিং অ্যালাউন্স গ্রহণ করা হয়। সে হিসেবে যশোর শিক্ষা বোর্ডেও এ ধারা চালু করা হয়েছে। আগেও এটি চালু ছিল। কিন্তু তৎকালীন চেয়ারম্যান মোল্লা আমির হোসেন এ চিঠির মাধ্যমে ওই অ্যালাউন্স গ্রহণ বন্ধ রেখেছিলেন। এরপর কর্মকর্তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আবার চালু করা হয়েছে।

কর্মকর্তাদের ‘সিটিং অ্যালাউন্স’ গ্রহণে সরকারি কোনো বিধি আছে কি না, জানতে চাইলে চেয়ারম্যান আহসান হাবীব এ বিষয়ে কিছু জানাতে পারেননি। তবে তিনি এ বিষয়ে স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘খোঁজ নিয়ে দেখেন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের চেয়ে আরও বেশি সিটিং অ্যালাউন্স গ্রহণ করে।’

এদিকে শিক্ষা বোর্ডের বিভিন্ন কমিটির বহিঃস্থ সদস্যরা ২০২১-২০২২ অর্থবছরে সিটিং অ্যালাউন্স (সম্মানি) হিসেবে ৪ লাখ ১২ হাজার ৭৫০ টাকা গ্রহণ করেন। এ বিষয়ে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর অডিটে আপত্তি জানায়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাপ্য না থাকা সত্ত্বেও অনিয়মিতভাবে নাম সংশোধন ও বয়স সংশোধন বাবদ ৪ লাখ ১২ হাজার ৭৫০ টাকা সিটিং অ্যালাউন্স হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের বিধিবদ্ধ নিরীক্ষা শাখার অডিট কর্মকর্তা এ কিউ এম জাকির হোসেন গত বছরের ২৫ জানুয়ারি আপত্তির নিষ্পত্তিমূলক জবাব দেওয়ার জন্য শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানকে চিঠি দেন।

যশোর সচেতন নাগরিক কমিটির সদস্য শাহীন ইকবাল একসময় বোর্ডের ক্রয় ও টেন্ডার কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কলেজে শিক্ষকতা করার সুবাদে কমিটির বহিঃস্থ সদস্য হিসেবে আমাকে মনোনিত করা হয়। আমরা যারা বাইরে থেকে ওই মিটিংয়ে উপস্থিত হতাম, তাদের যাতায়াত ভাতা দেওয়া হতো। বোর্ডের বিভিন্ন কমিটির অভ্যন্তরীণ সদস্যরা নিজেদের দপ্তরে বসে বৈঠক করে এই ভাতাপ্রাপ্তির যোগ্য হবেন কি না, তা সরকারি বিধিতে আরও স্পষ্ট করে প্রজ্ঞাপন জারি করা দরকার।’