ছয় বছর ধরে শ্রমজীবী মানুষের জন্য বিনা মূল্যে ইফতার আয়োজন
আসরের নামাজের পরই শ্রমজীবী মানুষজন জড়ো হতে থাকেন সুনামগঞ্জ পৌর শহরের কবি মমিনুল মউজদীন সড়কের প্রিয়াঙ্গন মার্কেটের সামনে। পুরুষদের সঙ্গে আসেন নারী, শিশুরাও। একটা সময় নিজেরাই সারি বেঁধে দাঁড়ান। এরপর তাঁদের হাতে ইফতারের প্যাকেট তুলে দেন একদল তরুণ। প্রতিদিন ২০০ শ্রমজীবী মানুষের জন্য ইফতারের আয়োজন করেন এই তরুণেরা।
শুধু এবারই নয়, পাঁচ বছর ধরে এই ইফতার আয়োজন করছেন তাঁরা। রিকশাচালক, দিনশ্রমিক অথবা আশপাশের দরিদ্র মানুষজন জানান, প্রিয়াঙ্গন মার্কেটের সামনে এলেই ইফতারি মিলবে। তাই অনেকে ইফতারি নিতে শিশুদের পাঠান। এ কারণে শিশুরাও জড়ো হয়। তবে আগে ইফতারি দেওয়া হয় বয়স্ক রোজাদারদের, পরে শিশুদের। তবে কাউকেই খালি হাতে ফিরতে হয় না।
সুনামগঞ্জ পৌর শহরের একদল তরুণ ছয় বছর ধরে প্রতি রমজানে পুরো মাস দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষদের জন্য এই ইফতারের আয়োজন করে আসছেন। এর জন্য নিজেরা যেমন অর্থ দেন, তেমনি তাঁদের এই মহতী উদ্যোগে অর্থ দিয়ে পাশে থাকেন দেশ-বিদেশের অনেকে।
প্রতিদিন ২০০ জনের ইফতারে ব্যয় হয় ১৫–২০ হাজার টাকা। শুধু ইফতার নয়, বন্যা, করোনাসহ নানা সংকটে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন এই তরুণেরা। একটি সংগঠনও রয়েছে তাঁদের, নাম ‘সোশ্যাল চ্যারিটি ফাউন্ডেশন’। সংগঠনের পুরো কাজ সমন্বয় করেন নাসিম চৌধুরী।
নাসিম চৌধুরী জানান, ২০১১ সালের কথা। প্রথমে বন্ধুরা মিলে এক ঈদে চিন্তা করেন এক বেলা সুবিধাবঞ্চিত ও হতদরিদ্র কিছু মানুষকে খাবার দেবেন। তখন সবাই শিক্ষার্থী। নিজেদের সঞ্চয় ও পরিবারের কাজ থেকে টাকা নিয়ে ওই বছর কিছু মানুষকে এক বেলা খাবার দেওয়ার কাজটি করেন তাঁরা। এতে অভিভাবকেরা উৎসাহ দেন। এরপর প্রতিবছর এ কাজ করতে থাকেন। ২০২০ সালে করোনার সময়ে যখন লকডাউন শুরু হয়, মানুষ বিপাকে পড়েন। তখন কী করা যায়, ভাবেন তাঁরা। শুরু করেন খাবার বিতরণ। নিজেরা রান্না করে একটা নির্ধারিত সময়ে খাবার বিতরণ করতে থাকেন। এ উদ্যাগে অনেকেই তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হন। এ বছর থেকেই ইফতারি বিতরণের কাজটিও শুরু করেন তাঁরা। এর পর থেকে প্রতিবছর ইফতারি বিতরণ করছেন। শুরুতে নিজেরা রান্না করতেন। এখন পরিসর বড় হওয়ায় একজন বাবুর্চি আছে। তবে রান্নার পর বাকি কাজ তাঁরা নিজেরাই করেন।
ইফতারের ঘণ্টাখানেক আগে থেকেই মানুষজন জড়ো হতে থাকেন। এর মধ্যে শ্রমজীবী মানুষেরা বেশি আসেন। আসেন আশপাশের এলাকার দরিদ্র পরিবারের নারীরা। শিশুরাও জড়ো হয় ইফতারি নিতে। সংগঠনের সদস্যরা সবাইকে সারিতে দাঁড় করান। পড়ে সুশৃঙ্খলভাবে সবার হাতে ইফতারির প্যাকেট তুলে দেওয়া হয়।
দিনমজুর ইছাক আলী (৪৫) বলেন, ‘সারা দিন কাম করি। ইফতারের আগে ইকানো আই। তারা ভালা খানি দেয়। পরতিদিন ইকানোই ইফতার করি। তারার লাগি দোয়া করি।’ শহরের ষোলঘর এলাকার বাসিন্দা রুহেদা বেগম (৪৮) প্রতিদিন তাঁর এক নাতিসহ ইফতারি নিতে আসেন এখানে। তাঁর ছেলে নির্মাণশ্রমিক। রুহেদা বেগম বলেন, ‘ঘরও তিনজন মানুষ আছইন। দুই প্যাকেট ইফতার নিয়া সবাই মিইল্যা খাই।’
ইফতারের যে প্যাকেট দেওয়া হয়, তাতে পোলাও, ডিম, খেজুর, পেঁয়াজু, ছোলা থাকে।
নাসিম চৌধুরী জানান, প্রথমে কয়েকজন বন্ধু মিলে এ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তখন সবাই শিক্ষার্থী ছিলেন। এখন কেউ ব্যবসা, কেউ চাকরি, কেউবা আছেন প্রবাসে। এখন ইফতার প্রস্তুত, বিতরণে স্বেচ্ছায় কাজ করেন অনেকে। নাসিম চৌধুরী বলেন, ‘আমরা নিজেরাই অর্থ দিয়ে প্রথমে শুরু করেছিলাম। এখন দেশ-বিদেশের অনেকেই সহযোগিতা করছেন। অনেকে উৎসাহ দেন। এটি এমন বড় কোনো কাজ নয়, তবু আমরা একধরনের তৃপ্তি পাই।’
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) সুনামগঞ্জের সদস্য শিক্ষক কানিজ সুলতানা বলেন, ‘এ উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত তরুণেরা শহরের পরিচিত মুখ। মানবিক কাজে আমরা সব সময় তাঁদের দেখি। তাঁদের উদ্যোগগুলো অবশ্যই প্রশংসনীয়।’