৩ শিক্ষা বোর্ডে অডিটে গিয়ে ৩৯ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ, জমা হয় স্বজনের হিসাবে
দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডে সম্প্রতি অডিট দল তাদের নিরীক্ষা সম্পন্ন করেছে। এই নিরীক্ষা চলাকালে বোর্ডের নানা অনিয়ম ঢাকতে অডিট দলকে সাড়ে ২১ লাখ টাকা ঘুষ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ঘুষ লেনদেনের এই একটি বিষয় খোঁজ করতে গিয়ে একই অডিট দলের ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডের কাছ থেকে ৬ লাখ টাকা এবং রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড থেকে ১২ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে। আড়াই মাসের ব্যবধানে অডিটের নামে তিন শিক্ষা বোর্ড থেকে অডিট দলটি মোট সাড়ে ৩৯ লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে নিরীক্ষা প্রতিবেদন দিয়েছে বলে জানা গেছে।
এসব অনিয়মের সঙ্গে শিক্ষা বোর্ডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা জড়িত। ঘুষ লেনদেনের কিছু নথিপত্র প্রথম আলোর কাছে এসেছে।
পাঁচ বছরের খাতা একসঙ্গে কেনা হয়
দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কয়েকজন বলেন, বোর্ডের পরীক্ষার জন্য সাধারণত প্রতিবছর দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে খাতা কেনা হয়। তবে চলতি অর্থবছরের শুরুতে নিয়মবহির্ভূতভাবে এক দরপত্রেই একসঙ্গে পাঁচ বছরের খাতা কেনা হয়েছে। যার মূল্য ২১ কোটি ২৫ লাখ ৩৮ হাজার টাকা। এই দরপত্রে যতগুলো খাতা সরবরাহ করার কথা ছিল, তার সব সরবরাহ করতে হয়নি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। কারণ, বোর্ডের ভান্ডারে আগেই জমা ছিল কিছু খাতা। নতুন খাতা ঠিক ততগুলোই কম ঢুকেছে। ওই টাকা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগসাজশে আত্মসাৎ করেছেন বোর্ড কর্মকর্তারা।
শিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালের ২৫ আগস্ট তিনটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার মূল উত্তরপত্র, অতিরিক্ত উত্তরপত্র, ব্যবহারিক উত্তরপত্র (কভারসহ), বহু নির্বাচনী ও ওএমআর শিটসহ মোট ১ কোটি ৮০ লাখ খাতা কেনার দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্র দাখিল করেছিল মাস্টার সিমেক্স পেপার লিমিটেড, প্রিন্ট মাস্টার প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, বাংলাদেশ মনোস্পোল পেপার লিমিটেড এবং এলিট প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড। সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে ২১ কোটি ২৫ লাখ ৩৮ হাজার টাকায় কার্যাদেশ পায় মাস্টার সিমেক্স পেপার লিমিটেড। এর মধ্যে ১০ শতাংশ কমিশন দিতে হয়েছে বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। ২০২৩-এর ৫ নভেম্বর ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খাতা সরবরাহ করে এবং ২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে বিল উত্তোলন করে।
দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের তিনতলা ভবনটিতে (সাড়ে চার হাজার বর্গফুট) বর্তমানে হাঁটার জায়গা নেই। এসব খাতা আগামী চার বছরেও শেষ হবে না। পড়ে থেকে থেকে লেখার উপযোগিতা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কাও আছে।
শুধু দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ড নয়, ৭ নভেম্বর একই ব্যাংকের ময়মনসিংহ বিজনেস সেন্টার শাখা থেকে ৬ লাখ টাকা এবং ১১ ডিসেম্বর রাজশাহী করপোরেট শাখা থেকে ১২ লাখ টাকাসহ মোট সাড়ে ৩৯ লাখ টাকা ওই একই নারী শারমিন আক্তারের ব্যাংক হিসাবে জমা হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বোর্ডের সাবেক ও বর্তমান ঊর্ধ্বতন দুই কর্মকর্তা জানান, দেশের কোনো শিক্ষা বোর্ডেই একসঙ্গে পাঁচ বছরের খাতা কেনা হয় না। সর্বোচ্চ দুই বছরের খাতা কেনা হয়। এর বেশি কেনা হলে খাতা উইপোকায় নষ্ট করা বা লেখার অনুপযোগী হবে।
অডিট দল যেভাবে ঘুষ নেয়
শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর গত ৮ অক্টোবর প্রকাশিত অফিস আদেশে সিলেট, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, রাজশাহী ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের নিয়মানুগ নিরীক্ষার কথা জানায়। ১৫ অক্টোবর থেকে ৩১ ডিসেম্বর চার কর্মকর্তার একটি অডিট দল শিক্ষা বোর্ডগুলো পরিদর্শন করবেন বলে জানানো হয়। ওই অডিট দলে ছিলেন অধিদপ্তরের উপপরিচালক মুহাম্মদ আলমগীর (দলনেতা), সহকারী পরিচালক সৌরভ হাসান (উপ-দলনেতা), এসএএস অধীক্ষক মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন (সদস্য) ও তানজির আলম (সদস্য)।
তবে ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডে নিরীক্ষা শুরুর কয়েক দিন আগে সামাজিক নিরাপত্তা অডিট বিভাগে বদলি হন অডিট দলের প্রধান মুহাম্মদ আলমগীর। পরে সেখানে স্থলাভিষিক্ত হন শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের উপপরিচালক আতিকুল ইসলাম।
দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডে নিরীক্ষা সম্পন্ন হয় ১৪ নভেম্বর থেকে ২৮ নভেম্বরের মধ্যে। বোর্ডের সূত্রের তথ্য, নিরীক্ষা চলাকালে অনিয়ম ঢাকতে অডিট দলের সঙ্গে লিয়াজোঁ করেন বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক আবু সায়েমসহ তিন কর্মকর্তা।
বোর্ড সূত্র জানায়, নিরীক্ষা সম্পন্ন হওয়ার এক দিন আগেই সরকারি একটি ব্যাংকের মাধ্যমে অডিট দলের পক্ষে উপ-দলনেতা সৌরভ হাসান সাড়ে ২১ লাখ টাকা ঘুষ নেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ২৭ নভেম্বর বিকেল চারটায় দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডসংলগ্ন একটি সরকারি ব্যাংক থেকে শারমিন আক্তার রুম্পা নামের এক নারীর ব্যাংক হিসাবে ওই সাড়ে ২১ লাখ টাকা জমা হয়। ব্যাংক হিসাবে শারমিন আক্তারের ঠিকানা উল্লেখ রয়েছে যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলা।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, শুধু দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ড নয়, একই অডিট দল গত ৩০ অক্টোবর থেকে ১৩ নভেম্বর ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডে এবং ৩০ নভেম্বর থেকে ১৫ ডিসেম্বর রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে নিরীক্ষা কার্যক্রম করে। এর মধ্যে ৭ নভেম্বর ওই সরকারি ব্যাংকের ময়মনসিংহ বিজনেস সেন্টার শাখা থেকে ৬ লাখ টাকা এবং ১১ ডিসেম্বর রাজশাহী করপোরেট শাখা থেকে ১২ লাখ টাকাসহ মোট সাড়ে ৩৯ লাখ টাকা ওই একই নারী শারমিন আক্তারের ব্যাংক হিসাবে জমা হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। সবশেষ গত ১৮ ডিসেম্বর বিকেল চারটা পর্যন্ত ওই নারীর ব্যাংক হিসাবে ২৫ লাখ ২৬ হাজার ৩৯৪ টাকা স্থিতি থাকার কথা জানা গেছে।
ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডের সচিবের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব না হলেও রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের সচিব মো. হুমায়ুন কবির প্রথম আলোকে বলেন, অডিট চলাকালীন প্রতিনিধিদের জন্য স্বাভাবিকভাবে কিছু খরচ হয়, তবে কোনো ঘুষ দেওয়া হয়নি।
মুঠোফোন বন্ধ পাওয়ায় এ বিষয়ে কথা বলা সম্ভব হয়নি অডিট দলের প্রধান আতিকুল ইসলামের সঙ্গে। সৌরভ হাসান আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি অস্বীকার করলেও ব্যাংক থেকে তাঁর স্বাক্ষরে টাকা স্থানান্তরের বিষয়টি তুলে ধরতেই একপর্যায়ে স্বীকার করেন। সৌরভ হাসান জানান, দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডে নিরীক্ষা শেষে মোট ২০টি বিষয়ে আপত্তি দেওয়া হয়েছে। যে নারীর ব্যাংক হিসাবে অর্থ গ্রহণ করা হয়েছে, সম্পর্কে তিনি খালাতো বোন বলে সৌরভ হাসান স্বীকার করেন। আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বুঝেনই তো ভাই, এখানে অনেকেই আছেন।’ তারপর আর কথা বাড়াতে চাননি সৌরভ হাসান।
অডিট দলের সদস্য মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন বলেন, ‘অডিটে গিয়ে আমি কাজ করেছি ঠিকই, কিন্তু এসব আর্থিক লেনদেন কিংবা অন্য কোনো বিষয়ের সঙ্গে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই, আমি এসবের কিছুই জানি না।’
টাকা আসে কোত্থেকে
ঘুষের টাকা আসে কোন খাত থেকে—এ প্রশ্নে বোর্ডের সাবেক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এই টাকার কোনো হিসাব থাকে না। সাধারণত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বরাদ্দ বিভিন্ন উৎসব ভাতা থেকে টাকা কর্তন, সম্মিলিত বিভিন্ন বিল থেকে টাকা কর্তন, স্কাউট, গার্ল গাইডস, রেড ক্রিসেন্ট ফি বাবদ বোর্ডে জমা করা অর্থ থেকে কর্তন করে অ্যাকাউন্টে জমা হয়। সেই টাকা প্রতিবছর অডিটের জন্য খরচ করা হয়।
বোর্ডের সূত্র জানায়, একটি সনদপত্র বাবদ ফরম পূরণের সময় টাকা নেওয়া হয় ১০০ টাকা। অথচ সনদপত্র বাবদ ব্যয় ও বোর্ডের প্রফিটসহ দরকার পড়ে ৩৬ টাকা। সেখানে সম্মানী বাবদ অতিরিক্ত নেওয়া হয় ৬৪ টাকা। একইভাবে মার্কশিটে ব্যয় হয় ১৫ টাকা, অথচ ফরম পূরণের সময় নেওয়া হয় ৫০ টাকা। এই অতিরিক্ত টাকাগুলো একত্রে জমা হয় বোর্ডের গোপন তহবিলে।
অডিট দলকে ঘুষ দেওয়া এবং বোর্ডের বিভিন্ন আর্থিক অনিয়মের সঙ্গে সম্পৃক্ততার বিষয়ে জানতে চাইলে কলেজ পরিদর্শক আবু সায়েম বলেন, ‘প্রতিবছর অডিট করার সময় কিছু খরচাপাতি হয়। কিন্তু আপনারা যতটা বলছেন, ততটা না।’ বোর্ডের আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এগুলো ভিত্তিহীন অভিযোগ। প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক স্বীকৃতি কিংবা পাঠদানের অনুমতির ক্ষেত্রে বোর্ডের কমিটি গঠন করা আছে। সংশ্লিষ্টরা পরিদর্শন শেষে রিপোর্ট দেন, তারপর অনুমোদন দেওয়া হয়।’
এসব বিষয়ে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান স ম আব্দুস সামাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘অডিটের বিষয়গুলো সাধারণত হিসাব শাখা দেখভাল করে থাকে। যে অভিযোগের কথা জানলাম, বিষয়গুলো তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’