মায়ের গায়ে হাত তোলায় ছোট ভাইয়ের স্ত্রীকে পিটিয়ে হত্যা করেন ভাশুর: পিবিআই
প্রায় ১১ বছর আগে গৃহবধূ রুমা বেগমের (৩৫) স্বামীর মৃত্যু হয়। স্বামীর মৃত্যুর পর একমাত্র সন্তানের (১৩) ভবিষ্যতের কথা ভেবে তিনি শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন। কিন্তু কিছু হলেই তাঁকে শারীরিক নির্যাতন করতেন ভাশুর সাফায়েত। ঘটনার দিন সকালের খাবার নিয়ে নিজের ছেলেকে একটি চড় মারেন রুমা। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে শাশুড়ি রূপসী বেগম তাঁকে একটি থাপ্পড় মারেন। একপর্যায়ে উত্তেজিত হয়ে রুমা শাশুড়িকে লাথি মারেন। মায়ের গায়ে হাত তোলায় সাফায়েত হোসেন তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করেন। পরে লাশ বাড়ি থেকে দূরের একটি কবরস্থানে ফেলে আসেন।
রুমা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের স্বীকারোক্তির বরাত দিয়ে আজ মঙ্গলবার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কুমিল্লার পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান এসব কথা বলেন। দুপুরে নগরের হাউজিং এস্টেট এলাকায় তাঁর দপ্তরে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
২০২১ সালের ২৩ নভেম্বর কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার বারপাড়া এলাকার মানিককান্দি ভূঁইয়া বাড়ির কবরস্থান থেকে এক নারীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। প্রাথমিক তদন্তে তিনি হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার বিষয়টি উঠে এলে প্রাথমিকভাবে পরিচিত কাউকে না পাওয়া যায় স্থানীয় গ্রাম পুলিশের সদস্য বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দাউদকান্দি থানায় মামলা করেন।
ওই দিনই লাশ মর্গে পাঠানোর পর স্বজনেরা বিভিন্ন মাধ্যমে খবর পেয়ে ওই নারীকে শনাক্ত করেন। তিনি উপজেলার ইলিয়টগঞ্জ এলাকার লক্ষ্মীপুর গ্রামের মো. দুলাল মিয়ার মেয়ে ও ভিটি চারীপাড়া গ্রামের প্রয়াত মোস্তফা মিয়ার স্ত্রী রুমা।
পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান বলেন, ওই নারীর লাশ উদ্ধারের দুই দিন আগে ২১ নভেম্বর সকালে ওই নারীকে শ্বশুরবাড়ির লোকজন হত্যা করেন। এরপর দিনভর লাশ বাড়িতে লুকিয়ে রেখে রাতে মানিককান্দি ভূঁইয়া বাড়ির কবরস্থানে ঝোপের মধ্যে ফেলে আসেন। তাঁরা চেয়েছিলেন যেন ওই নারীর পরিচয় না পাওয়া যায়। হত্যাকাণ্ডের দিন দুপুরে ভাশুর সাফায়েত ওই নারীর বাবার বাড়িতে গিয়ে খবর দেন তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পরদিন মা রূপসী বেগমকে দিয়ে থানায় নিখোঁজ হওয়ার জিডি করান।
মিজানুর রহমান বলেন, এ ঘটনায় গত বছরের ২৪ আগস্ট ভাশুর সাফায়াতকে গ্রেপ্তার করা হলেও জিজ্ঞাসাবাদে তিনি মুখ খোলেননি। তবে তাঁর কথাবার্তায় পুলিশের সন্দেহ হয়। সর্বশেষ গতকাল সোমবার ভোরে নিহত নারীর শ্বশুরবাড়ি থেকে আরেক ভাশুর জীবন মিয়ার স্ত্রী জ্যোৎস্না আক্তারকে গ্রেপ্তার করা হয়। ঘটনার পর থেকে জ্যোৎস্না পলাতক ছিলেন। গত রোববার রাতে তিনি গোপনে বাড়িতে আসেন। সোমবার বিকেলে হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে কুমিল্লার দাউদকান্দির আমলি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন তিনি। মূলত সন্তানকে শাসন ও মায়ের গায়ে হাত তোলার জেরে ভাশুর সাফায়েত, ভাগনে আল-আমিনসহ শ্বশুরবাড়ির কয়েকজন মিলে রুমাকে হত্যা করেন।
আদালতে দেওয়া জবানবন্দি ও জ্যোৎস্নাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে পিবিআই জানায়, ঘটনার দিন সকালে ডাল রান্না না করায় মা রুমা বেগমের সঙ্গে চিল্লাচিল্লি করে তাঁর ছেলে। এতে বিরক্ত হয়ে ছেলেকে একটি চড় মারেন তিনি। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে শাশুড়ি পুত্রবধূ রুমাকে চড় মারেন। একপর্যায়ে রুমাও উত্তেজিত হয়ে শাশুড়িকে লাথি মারেন। এ সময় সাফায়েত ওই নারীকে মারধর করলে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং মারা যান। ঘটনার সময় ভাশুর সাফায়েত, শাশুড়ি রূপসী বেগম, রূপসীর পুত্রবধূ জ্যোৎস্না, কোহিনুর আক্তার, সুমি আক্তার আর সাফায়েতের ভাগনে আল-আমিন উপস্থিত ছিলেন। এরপর শাশুড়ি ও তিন পুত্রবধূ রুমার লাশ সারা দিন ঘরে লুকিয়ে রাখেন। রাতে সাফায়েত ও আল-আমিন লাশ ওখানে ফেলে আসেন। এর মধ্যে সাফায়েত ওই নারীর বাবার বাড়ি গিয়ে বলেন, রুমা কাউকে কিছু না বলে কোথাও চলে গেছেন। আর পরদিন মাকে নিয়ে থানায় জিডি করান সাফায়েত।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিটিআইএর উপপরিদর্শক (এসআই) সাফায়েত আহাম্মদ বলেন, গ্রেপ্তার জ্যোৎস্নাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। অন্য আসামিদেরও গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। সাফায়েত এখন জামিনে আছেন। শিগগিরই আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে।