গোসাইরহাট পৌরসভায় বিদ্রোহী নিয়ে চাপে আওয়ামী লীগ
আওয়ামী লীগ থেকে দলীয় প্রার্থীসহ পাঁচজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এতে বিভক্তি তৈরি হওয়ায় দলীয় প্রার্থী বেকায়দায় পড়েছেন।
আর এক দিন পরেই শরীয়তপুরের গোসাইরহাট পৌরসভার নির্বাচন। শেষ মুহূর্তের প্রচারণায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা। তিন বিদ্রোহী থাকায় আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী জাকির হোসেন চাপে আছেন। একই দল থেকে চারজন প্রার্থী হওয়ায় আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরাও দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে আছেন। তবে আওয়ামী লীগের দুই বিদ্রোহী মেয়র প্রার্থী ও বিএনপির ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত অপর এক প্রার্থী সুবিধাজনক অবস্থায় আছেন বলে স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও পৌরসভার ভোটাররা জানিয়েছেন।
নির্বাচনী মাঠে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর অবস্থান যে দুর্বল, তা দলের নেতা–কর্মীদের মন্তব্যেই প্রকাশ পেয়েছে। এ বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অনল কুমার দে প্রথম আলোকে বলেন, স্বতন্ত্র (বিদ্রোহী) প্রার্থী থাকার কারণে নৌকার প্রার্থীর অবস্থান অনেকটা দুর্বল। আমরা দলের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের নিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের আনার চেষ্টা করছি।’
উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, গোসাইরহাট উপজেলা সদর ইদিলপুর ইউনিয়নে। ২০০৩ সালে ওই ইউনিয়নের সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
এরপর ২০১১ সালে উপজেলা সদরের ১৭ বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে আলাদা করে পৌরসভা ঘোষণা করে স্থানীয় সরকার বিভাগ। পৌরসভার কার্যক্রম চালানোর জন্য তখন সেখানে প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পৌরসভার প্রশাসক নিযুক্ত হন। সীমানা জটিলতার মামলার কারণে দীর্ঘ ১২ বছর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি।
উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে আরও জানা যায়, সীমানা জটিলতার মামলা নিষ্পত্তি হওয়ায় গোসাইরহাট পৌরসভায় ১৭ জুলাই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই নির্বাচনে আটজন মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তাঁরা হলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাকির হোসেন (নৌকা), আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী দেওয়ান মোহাম্মদ শাহজাহান (জগ), আবদুল আউয়াল সরদার (নারিকেলগাছ), মুহাম্মদ আবদুল কাদের আলামিন (হেলমেট), মতিউর রহমান (মোবাইল ফোন), তাঁর স্ত্রী হাসিনা আক্তার (হ্যাঙ্গার), জিয়াউর রহমান (কম্পিউটার), মিন্টু জমাদ্দার (চামচ)।
উপজেলা আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় ৫ জুলাই আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান মোহাম্মদ শাহজাহান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল আউয়াল সরদারকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আর পৌরসভা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ আবদুল কাদের আলামিন উচ্চ আদালত থেকে প্রার্থিতা ফিরে পেয়ে প্রচার–প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন।
এমন পরিস্থিতিতে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও আওয়ামী লীগের ভোটাররা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। এতে দলের মনোনীত প্রার্থী বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারেন এমন আশঙ্কা করছেন আওয়ামী লীগের নেতারা।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহজাহান সিকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘দলের ভেতরে যে কোন্দল ও বিদ্রোহ আছে, তা নিরসনের চেষ্টা করেছিলাম। কয়েকজন শুনেছেন। কয়েকজন না শুনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তারপরও পরিস্থিতি অনুকূলে নেই। আমাদের প্রার্থী কিছুটা বেকায়দা আছেন। আমরা ভোটারদের কাছে আওয়ামী লীগের উন্নয়ন চিত্র তুলে ধরছি।’
উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতারা জানান, দলটির স্থানীয় পর্যায়ের আটজন নেতা মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য প্রস্তুতি নেন। উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি জাকির হোসেন দুলালকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়। দলের ওই সিদ্ধান্ত না মেনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান মোহাম্মদ শাহজাহান, সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল আউয়াল সরদার, পৌরসভা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ আবদুল কাদের আলামিন। এ ছাড়াও মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন গোসাইরহাট পৌরসভা আওয়ামী লীগের সভাপতি মতিউর রহমান, তাঁর স্ত্রী হাসিনা আক্তার। এ ছাড়া মেয়র পদে বিএনপির ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিতি জিয়াউর রহমান জমাদ্দার ও তাঁর ভাই মিন্টু জমাদ্দার।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে উপজেলা আওয়ামী লীগের একজন সাংগঠনিক সম্পাদক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দলের মনোনয়নটি একজন দুর্বল ব্যক্তিকে দেওয়া হয়েছে, যিনি পৌরসভার ভোটার ছিলেন না। নির্বাচন করার জন্য কয়েক মাস আগে এই পৌরসভার ভোটার হয়েছেন। এসব কারণে দলের মধ্যের একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন। নেতা-কর্মী ও ভোটাররা বিভক্ত হয়ে পড়ায় দলের প্রার্থীর অবস্থান আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে। এ সুযোগটি বিএনপির ঘনিষ্ঠ হিসিবে পরিচিত প্রার্থী কাজে লাগানো চেষ্টা করছেন।’
তবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাকির হোসেন দুলাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিদ্রোহ করে কোনো লাভ নেই। শেখ হাসিনা আমাকে মূল্যায়ন করে দলীয় প্রতীক দিয়েছেন। আমি জয়ী হয়ে তাঁর মর্যাদা রাখব।’
বিদ্রোহী প্রার্থী দেওয়ান মোহাম্মদ শাহজাহান প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিটি মানুষের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার রয়েছে। আমার সঙ্গে ভোটার ও তৃণমূলের আওয়ামী লীগের সাধারণ নেতা-কর্মীরা রয়েছেন। ভালো কিছু করতে পারব বলে আশাবাদী।’
স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল আউয়াল সরদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘দল থেকে কেন একজন ভুল মানুষকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, তা আমি বলতে পারছি না। তবে ভোটার ও নেতা-কর্মীরা ভুল সিদ্ধান্তের পক্ষে নেই। তাঁদের চাপেই প্রার্থী হয়েছি।’
স্বতন্ত্র প্রার্থী মুহাম্মদ আবদুল কাদের আলামিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘উচ্চ আদালত থেকে প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছি। প্রতীক পেয়ে মাঠে প্রচার প্রচারণায় অংশ নিচ্ছি। নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য দলের নেতাদের চাপ রয়েছে। নির্বাচনের মাঠে টিকে থাকার চেষ্টা করছি।’
গোসাইরহাটের দাসেরজঙ্গল এলাকার এক ভোটার নাম না প্রকাশ করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের তিন নেতা বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ায় দলীয় প্রতীক পাওয়া প্রার্থী পিছিয়ে পড়েছেন। এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন বিএনপি ঘনিষ্ঠ জিয়াউর রহমান। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী (স্বতন্ত্র প্রার্থী) আবদুল আউয়াল সরদার ও দেওয়ান মোহাম্মদ শাহজাহান পৌর শহরের বাসিন্দা হওয়ায় তাঁদের মাঠে অবস্থান ভালো। আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সমর্থকদের বিরুদ্ধে নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ উঠেছে। এ কারণে ভোটাররা তাঁকে পছন্দ করছেন না। ভোট প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়বে।