একটি মিষ্টির দাম ১০ হাজার টাকা, ৩৫ হাজারে বিক্রি হলো একটি মাছ

মেলায় বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। বুধবার সকালে বগুড়ার গাবতলী উপজেলার পোড়াদহ এলাকায়ছবি: সোয়েল রানা

শিমুল-পলাশের রং ছড়িয়ে প্রকৃতিতে উঁকি দিচ্ছে বসন্ত। সকালে রোদের তেজ ছড়িয়ে শীতের বিদায়লগ্নের জানান দিচ্ছে মাঘ। হালকা কুয়াশার সঙ্গে কমলা রঙের রোদের মনোমুগ্ধকর মিতালিতে বগুড়ার গাবতলী উপজেলার মহিষাবান ইউনিয়নের ইছামতী নদীর অদূরে ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহ সন্ন্যাসী মেলা বসেছে। ৪০০ বছরের পুরোনো এই মেলা স্থানীয়ভাবে জামাই মেলা নামে পরিচিত। মেলা উপলক্ষে ইছামতীর অদূরে বিস্তীর্ণ মাঠে বসেছে সারি সারি দোকান।

মেলার প্রধান আকর্ষণ নদী আর বিলের বিশাল আকৃতির হরেক রকমের মাছ। দোকানিরা বড় বড় মাছের পসরা সাজিয়ে বসেছেন। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই দোকানে দোকানে মানুষের ঢল। ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাঁকডাকে সরগরম এলাকা। মেলায় অন্যতম আকর্ষণ ছিল যমুনা নদীতে ধরা পড়া ২৭ কেজি ওজনের একটি বাগাড় ও ২৫ কেজি ওজনের কাতলা মাছ। মাছ দুটি যথাক্রমে ৩৫ হাজার ও ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়।

মাছ ছাড়াও হরেক পদের বাহারি মিষ্টান্ন, খেলনা, কাঠের আসবাব, প্রসাধনীর দোকানসহ বিনোদনের জন্য বসেছে চরকি, নাগরদোলা, মৃত্যুকূপে মোটরসাইকেল খেলা, সার্কাস, ম্যাজিক শোসহ নানা আনন্দ আয়োজন। মেলা ঘিরে শতাধিক গ্রামে বিরাজ করে উৎসবের আমেজ। মেলা উপলক্ষে জামাতাসহ আত্মীয়স্বজনকে নিমন্ত্রণ জানানো হয়। মেলা থেকে শৌখিন মাছ কিনে শ্বশুরবাড়িতে নিমন্ত্রণ খেতে যাওয়ার চল আছে গাবতলী, সারিয়াকান্দি, ধুনটসহ এ অঞ্চলে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মেলা শুরুর সঠিক দিনক্ষণ কেউ জানেন না। তবে এলাকায় প্রচলিত আছে, ৪০০ বছরের বেশি সময় আগে পোড়াদহ-সংলগ্ন ইছামতী নদীতে প্রতিবছরের মাঘ মাসের শেষ বুধবার অলৌকিকভাবে বড় একটি কাতলা মাছ সোনার চালুনি পিঠে নিয়ে ভেসে উঠত। অলৌকিক এ ঘটনা দেখতে অনেকে জড়ো হতেন। পরে স্থানীয় এক সন্ন্যাসী স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে অলৌকিক মাছের উদ্দেশ্যে অর্ঘ্য নিবেদনের জন্য সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেন। সন্ন্যাসীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে পোড়াদহ বটতলায় মাঘের শেষ বুধবার স্থানীয় লোকজন অর্ঘ্য নিবেদন শুরু করেন। নাম দেন সন্ন্যাসী পূজা। পূজা ঘিরে লোকসমাগম বাড়তে থাকে ও বড় বড় মাছ বেচাকেনার জন্য মেলাটি প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে। কালক্রমে মেলাটি পোড়াদহের মেলা হিসেবে পরিচিতি পায়। ইছামতী, করতোয়া, যমুনা ও বাঙ্গালী নদীতে ধরা বাহারি মাছ বিক্রির জন্য মেলায় নেন জেলেরা। মেলায় মাছ কিনতে দূরদূরান্ত থেকে ভিড় করেন ক্রেতা ও দর্শনার্থীরা। বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে, প্রতিবছরের মাঘ মাসের শেষ বুধবার ইছামতী নদীর তীরে পোড়াদহ মেলা বসে। মেলা এক দিনের হলেও আবহ থাকে কয়েক দিন।

মেলার অন্যতম আকর্ষণ যমুনায় ধরা পড়া ২৭ কেজি ওজনের বাগাড়। সকাল ১০টার আগেই মাছটি ৩৫ হাজার টাকায় ভাগাভাগি করে কিনে নিয়েছেন মহিষাবান গ্রামের কয়েকজন
ছবি: প্রথম আলো

গোলাবাড়ি বাজার বণিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শামীম হাসান বলেন, ৪০০ বছরের ঐতিহ্যের সাক্ষী পোড়াদহ মেলা। একসময় মেলা থেকে শখের মাছ কিনে ইছামতী নদীতে সওদাগরি নৌকা ভাসিয়ে ঘরে ফিরতেন বাণিজ্য করতে আসা সওদাগররা। ঐতিহ্য ধরে রেখে এখনো মাছের মেলা বসেছে। অর্থনৈতিকভাবেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতিবছর মেলায় কয়েক কোটি টাকার লেনদেন হয়। এটি গ্রামীণ অর্থনীতিতেও অবদান রাখছে।

বাহারি সব মাছের মেলা

বুধবার মেলায় গিয়ে দেখা যায়, ক্রেতা-দর্শনার্থীদের ঢল নেমেছে। মাছের দোকানে চলছে জমজমাট বেচাকেনা। পুকুর, দিঘি, নদ–নদী, বিলের বড় বড় মাছ নিয়ে দোকান দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। দোকানে দোকানে ঝুলছে রঙিন জরি। বড় বড় বাগাড়, রুই-কাতলা, চিতল, আইড়, বোয়ালসহ নানা জাতের মাছ সাজানো। একেকটি মাছ ৫ থেকে ৩০ কেজি পর্যন্ত ওজন। ক্রেতারা মাছ পরখ করে দরদাম করে কিনছেন।

মেলার আয়োজক কমিটির সভাপতি ও মহিষাবান ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, অন্য বছরের মতো এবারের মেলাও জমজমাট। মেলায় প্রায় চার হাজার দোকান বসেছে। এর মধ্যে ৪০০ দোকানে বাহারি মাছ বিক্রি হচ্ছে। প্রতিটি দোকানে গড়ে ৫ লাখ টাকার মাছ বিক্রির আশা করছেন বিক্রেতারা। সেই হিসাবে এক দিনে মেলায় আনুমানিক ২০ কোটি টাকার মাছ বেচাবিক্রি হবে।

এবারের মেলার অন্যতম আকর্ষণ ছিল যমুনায় ধরা পড়া ২৭ কেজি ওজনের তাজা বাগাড়। সিরাজগঞ্জের মাছ ব্যবসায়ী জমির উদ্দিন সকালে মাছটির দাম চান ৬০ হাজার টাকা। পরে ৩৫ হাজার টাকায় বিক্রি করেন। সিরাজগঞ্জের আরেক ব্যবসায়ী সুজন মেলায় ২৫ কেজি ওজনের কাতলা মাছ ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। ব্যবসায়ী জমির উদ্দিন বলেন, ‘অনেকে দরদাম করেছেন। তবে এবার মেলায় ক্রেতা কম। ৩৫ হাজার টাকায় বাগাড় মাছটি বিক্রি করেছি।’

মেলা থেকে মাছ কিনে শ্বশুরবাড়িতে নিমন্ত্রণ খেতে যাওয়ার চল আছে বগুড়ায়। কে কত বড় মাছ কিনলেন, জামাইদের মধ্যে সেই প্রতিযোগিতাও চলে
ছবি: প্রথম আলো

মাছ ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, মেলায় একসময় যমুনা, করতোয়া, ইছামতী, বাঙ্গালী নদীতে ধরা পড়া মাছ বেশি বিক্রি হতো। এখন পুকুর-দিঘিতে চাষ করা বড় বড় শৌখিন মাছ বেশি বিক্রি হচ্ছে। এবারের মেলার অন্যতম আকর্ষণ যমুনায় ধরা পড়া ২৭ কেজি ওজনের বাগাড়। সকাল ১০টার আগেই মাছটি ৩৫ হাজার টাকায় ভাগাভাগি করে কিনে নিয়েছেন মহিষাবান গ্রামের কয়েকজন। এ ছাড়া ২৫ কেজি ওজনের কাতলা মাছটি ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে।

ব্যবসায়ীরা জানান, মেলায় বড় কাতলা মাছ প্রতি কেজি গড়ে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা, রুই ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা, বিগহেড ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা, সিলভার কার্প ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা, গ্রাসকার্প ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা, বোয়াল ১ হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা, চিতল দেড় হাজার থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা, পাঙাশ ৩৫০ থেকে ১ হাজার টাকা, ব্লাডকার্প ৪০০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

ঘরে ঘরে জামাই উৎসব

স্থানীয় লোকজন জানান, ঐতিহ্যবাহী মেলা ঘিরে গাবতলীর মহিষাবান ইউনিয়ন ছাড়াও আশপাশের গাবতলী সদর, দুর্গাহাটা, বালিয়াদীঘি ও নশিপুর ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামে ঘরে ঘরে জামাই উৎসব চলছে। মেয়েরা বাবার বাড়ি নাইওর এসেছেন। শ্বশুরবাড়িতে নিমন্ত্রণ পেয়ে মেলা থেকে মাছ কিনে হাজির হন জামাইরা। কাল বৃহস্পতিবার সকালে এখানে বউ মেলা বসবে, যেখানে পুরুষ দর্শনার্থী নিষিদ্ধ। শুধু নারীদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে মেলা। মেলায় নারীদের জন্য প্রসাধনী ছাড়াও রকমারি পণ্যের পসরা বসবে।

মেলা উপলক্ষে শ্বশুরবাড়িতে এসেছেন জামাই মাসুদ হাসান। মেলায় ১৭ ও ১৫ কেজি ওজনের দুটি কাতলা মাছ কিনে বেজায় খুশি তিনি। মাসুদ বলেন, মেলা থেকে মাছ কিনে শ্বশুরবাড়িতে নিমন্ত্রণ খেতে যাওয়ার চল আছে এ অঞ্চলে। কে কত বড় মাছ কিনে শ্বশুরবাড়িতে যেতে পারেন, ঘরে ঘরে জামাইদের মধ্যে এমন প্রতিযোগিতাও চলে।

মেলায় অন্যতম আরেকটি আকর্ষণ মাছের আকৃতিতে বানানো বিশাল রসগোল্লা। বুধবার সকালে বগুড়ার গাবতলী উপজেলার পোড়াদহ এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

পাররানীরপাড়া গ্রামের জামাই জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘শ্বশুরবাড়িতে নিমন্ত্রণে এসেছি। ১২ হাজার টাকায় একটা বড় কাতলা মাছ কিনে শ্বশুরবাড়িতে যাচ্ছি।’ সামিউল ইসলাম বললেন, ‘মেলা থেকে মাছ কিনে শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার চল আছে। সেই কারণে ১২ কেজির ব্রিগহেড ও ১০ কেজি ওজনের একটি কাতলা কিনেছি।’

এক মিষ্টির দাম ১০ হাজার টাকা

মেলায় অন্যতম আরেকটি আকর্ষণ মাছের আকৃতিতে বানানো বিশাল বড় একটি রসগোল্লা। সিরায় ডোবানো এ মিষ্টি প্রতি কেজি ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। দোকানি আবদুল বারী ১৫ কেজি ওজনের মাছ আকৃতির বড় মিষ্টির দাম চেয়েছেন ১০ হাজার টাকা। রসগোল্লা ছাড়াও সন্দেশ, জিলাপি, নিমকি, বাতাসা, তিলের নাড়ু, খই, শুকনা মিষ্টি, কদমা, চিনি ও গুড়ের জিলাপিসহ হরেক রকমের মিষ্টান্ন বিক্রি হচ্ছে মেলায়।

শিশুদের জন্য ছিল মাটি ও কাঠের খেলনা, বাঁশি, টমটম, রঙিন বেলুন, বাঁশি, চটপটি, ফুচকা, মৌসুমি ফল, চাটনি, আচার। নারীদের জন্য কাচের চুড়ি, আলতা-ফিতা, লিপস্টিক, নেইল পলিশ, প্রসাধনীসহ নানা পণ্যের দোকানের পসরা বসেছে। বিনোদনের জন্য চরকি, নাগরদোলা, মৃত্যুকূপে মোটরসাইকেল খেলা, সার্কাসসহ নানা আনন্দ আয়োজন।

মাছের আকৃতির মিষ্টি
ছবি: প্রথম আলো

মেলায় ঘুরতে আসা বগুড়া শহরের শিক্ষার্থী রওনকুল আলম বলেন, ‘৪০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী মেলায় ঘুরতে আসার জন্য একটা বছর মুখিয়ে থাকি। বন্ধুদের সঙ্গে মেলায় ঘুরতে এসেছি। মেলায় সব আয়োজনে মুগ্ধ।’ তবে স্থানীয় ব্যক্তিদের অভিযোগ, মেলায় সার্কাস ও ম্যাজিক প্রদর্শনের নামে অশ্লীল নৃত্য প্রদর্শন করা হচ্ছে। চলছে জুয়ার আসর।

জানতে চাইলে গাবতলী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আশিক ইকবাল বলেন, মেলায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক রাখতে এক দিন আগে থেকেই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে দায়িত্ব পালন করছে পুলিশ। মেলায় অশ্লীল নৃত্য ও জুয়া বন্ধে সব রকমের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।