ইন্টারনেটের বহুমুখী ব্যবহারে লাভবান হতে চান নারায়ণগঞ্জের গ্রামীণ নারীরা

নারায়ণগঞ্জের ৫টি উপজেলার ১৮টি ইউনিয়নে সম্পন্ন হয়েছে উঠান বৈঠক। জেলাটির বন্দর উপজেলার ধামগড় ইউনিয়নের কামতাল গ্রামের উঠান বৈঠকের একটি চিত্রছবি: প্রথম আলো

স্মার্টফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারের সময় একটি ফ্যাশন হাউসে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখতে পান সান্ত্বনা আক্তার (২৫)। কাজটি হলো, ফ্যাশন হাউসটির পণ্যে ‘প্রোডাক্ট কোড’ বসানো। প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যোগাযোগ করেন, কাজটাও পেয়ে যান।

দেড় বছর ধরে ঘরে বসেই এই কাজ করছেন নারায়ণগঞ্জের গৃহিণী সান্ত্বনা আক্তার। প্রতি মাসে তাঁর আয় হয় সাত থেকে আট হাজার টাকা। সংসারে আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি ইন্টারনেট দুনিয়ার অনেক কিছুই জানতে ও শিখতে পারছেন তিনি। ইন্টারনেটের এ সুবিধা কাজে লাগিয়ে এখন নিজেই উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন সান্ত্বনা আক্তার। হতে চান স্বাবলম্বী। সান্ত্বনার স্বামী ওমর ফারুক পেশায় কাভার্ড ভ্যানচালক। উচ্চমাধ্যমিক শেষ করা সান্ত্বনা আক্তার-ওমর ফারুক দম্পতির রয়েছে দুই মেয়ে ও এক ছেলে।

সান্ত্বনার বাড়ি নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর উপজেলার ধামগড় ইউনিয়নের কামতাল গ্রামে। গত ২৫ নভেম্বর বিকেলে ওই গ্রামের আব্দুল খালেকের বাড়িতে উঠান বৈঠকের আয়োজন করা হয়। গ্রামীণফোনের উদ্যোগে ‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’ শীর্ষক প্রচারাভিযানের আওতায় এই বৈঠকে অংশ নেন সান্ত্বনা আক্তার। সেখানেই কথা হচ্ছিল তাঁর সঙ্গে।

গ্রামীণ নারীদের ইন্টারনেট বিষয়ে জ্ঞান বাড়াতে ১৬ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ জেলায় শুরু হয় উঠান বৈঠক। জেলার ৫টি উপজেলার ১৮টি ইউনিয়নে উঠান বৈঠক সম্পন্ন হয়েছে। ২৬ নভেম্বর কাশিপুর বাংলাবাজার এলাকায় মাসুদুজ্জামানের বাড়িতে আয়োজিত উঠান বৈঠকের মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জ জেলার উঠান বৈঠক কার্যক্রম শেষ হয়।

উঠান বৈঠকে অংশ নেওয়া এবং কুইজে বিজয়ী হওয়ার অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে সান্ত্বনা আক্তার বলেন, ‘আগে ইন্টারনেট মানেই বুঝতাম টিকটক, ইউটিউব ও ফেসবুকে সময় কাটানো। কিন্তু উঠান বৈঠক থেকে অনেক কিছু শিখতে পেরেছি। শুধু অনলাইনে কাজ করা নয়, বরং উদ্যোক্তা হওয়ার ইচ্ছা আছে আমার।’

ইন্টারনেটের বহুমুখী সুবিধা কাজে লাগিয়ে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন সান্ত্বনা আক্তার (বাঁয়ে)। তিনি নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার ধামগড় ইউনিয়নের কামতাল গ্রামের বাসিন্দা
ছবি: প্রথম আলো

নারায়ণগঞ্জের উঠান বৈঠকগুলোতে অংশ নেন বিভিন্ন ইউনিয়নের নানা বয়সী নারী। তাঁদের মধ্যে একজন গৃহিণী ফাহিমা আক্তার (২১), যিনি তাঁর মা সাহার বানুর কাছ থেকে সেলাইয়ের কাজ শেখেন। কামতাল গ্রামের ফাহিমা নিজের পাশাপাশি আত্মীয়স্বজন-প্রতিবেশীদের পোশাকও তৈরি করেন, যা থেকে ভালোই আয় হয় তাঁর। ফাহিমা বলেন, ‘হাতের কাজ মায়ের কাছ থেকে শিখলেও নকশার কাজগুলো ইউটিউব চ্যানেল থেকে শিখেছি। এখন ইন্টারনেট থেকে কীভাবে আয় করতে হয়, সে ব্যাপারেই শিখছি।’

উঠান বৈঠকে সান্ত্বনা ও ফাহিমা আক্তারের মতো অসংখ্য গ্রামীণ নারী অংশ নেন। অংশ নেওয়া অনেকেই এখনো সেভাবে ইন্টারনেটের ব্যবহার জানেন না। তাঁরাও এখন ইন্টারনেট ব্যবহারে আগ্রহী হয়েছেন। উঠান বৈঠকে এসে নতুন অনেক বিষয় শিখতে পেরেছেন লাকী আক্তার (৩৫)। সৌদিপ্রবাসী এ নারী তিন মাস আগে দেশে এসেছেন। লাকী আক্তার বলেন, ‘নারীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও শিশুস্বাস্থ্য বিষয়ে অনেক কিছু শিখতে পেরেছি। কীভাবে সন্তানের যত্নের পাশাপাশি নিজের যত্ন নেওয়া যায়, সেসব বিষয়ও জেনেছি। ইন্টারনেট থাকলে অনেক কিছু সহজে শেখা ও জানা যায়—উঠান বৈঠকে এসে সেটাও জানতে পারলাম।’

ইন্টারনেটের বহুমুখী ব্যবহার শেখাতে সারা দেশের দুই হাজারের বেশি ইউনিয়নে সম্পন্ন হয়েছে ‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’ শীর্ষক আয়োজন।

গত ২৬ নভেম্বর সকালে নারায়ণগঞ্জ জেলার উঠান বৈঠকের কার্যক্রম শেষ হয় কাশিপুর ইউনিয়নের বাংলাবাজার এলাকার মাসুদুজ্জামানের বাড়িতে। সেখানে অংশ নেন শতাধিক নারী। তাঁদের একজন শহরের পশ্চিম দেওভোগ এলাকার বাসিন্দা আইরিন বেগম (৩৪)। বাড়িতে টেইলার্সের কাজ করেন তিনি। তাঁর স্বামী মজিবর রহমান পোশাক কারখানায় কাজ করেন। দুই বছর যাবৎ ফেসবুক পেজ খুলে অনলাইনে পোশাক তৈরির কাজ করেন। তাঁকে ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে সহায়তা করেন তাঁর মেয়ে চাঁদ মনি। ননদ সুমিও অনলাইনে কাজ করে টাকা আয় করেন বলে জানান আইরিন।

নারায়ণগঞ্জ জেলার ১৮টি ইউনিয়নে উঠান বৈঠকের উপস্থাপনা করেন প্রথম আলো নারায়ণগঞ্জ বন্ধুসভার সভাপতি আফরিন সুলতানা জেমী। তিনি বলেন, ‘ইন্টারনেট দুনিয়ায় পুরো বিশ্ব এগিয়ে গেলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীদের অনেকেই এখনো স্মার্টফোন ব্যবহারই করেন না। ফলে ইন্টারনেট সম্পর্কে তাঁদের ধারণা সীমিত। উঠান বৈঠকের মধ্য দিয়ে তাঁরা খুঁটিনাটি অনেক বিষয় সহজেই জানতে ও শিখতে পেরেছে বলে আমার বিশ্বাস।’

এই জেলার উঠান বৈঠকে দলনেতা হিসেবে ছিলেন প্রথম আলো নারায়ণগঞ্জ বন্ধুসভার সাবেক সহসভাপতি আরাফাত বাপ্পি। সহায়তাকারী হিসেবে ছিলেন দপ্তর সম্পাদক আবরার জামান আফিফ, স্বাস্থ্য ও ক্রীড়া সম্পাদক সোয়াদ হোসেন, জেন্ডার সমতাবিষয়ক সম্পাদক অর্পিতা হোসেন ও কার্যকরী সদস্য আমান। দলনেতা আরাফাত বাপ্পি বলেন, ‘শুরুর দিকে উঠান বৈঠক আয়োজনের বিষয়ে মানুষের মধ্যে একধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করেছে। তবে শুরুতে অনীহা দেখালেও অনুষ্ঠান শেষে তাঁরা বেশ সন্তুষ্ট ছিলেন। এ ধরনের আরও অনুষ্ঠান আয়োজনের বিষয়ে বলেছেন। ইন্টারনেট ব্যবহার নিয়ে যাঁদের ভীতি ছিল, সেটাও দূর হয়েছে এই অনুষ্ঠানের অংশগ্রহণের মাধ্যমে।’

ইন্টারনেটের কল্যাণে গ্রামীণ নারীরা চলার পথে ছোটখাটো সমস্যার সমাধান নিজেরাই করতে পারবেন। সেই লক্ষ্যেই ‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’ শীর্ষক প্রচারাভিযান। এর আওতায় সারা দেশের দুই হাজার ইউনিয়নে চলছে উঠান বৈঠক। গ্রামীণফোনের উদ্যোগে আয়োজনটির সহযোগিতায় রয়েছে প্রথম আলো, নকিয়া ও ঢাকা ব্যাংক। ২০২৩ সালের মার্চে শুরু হওয়া কার্যক্রমটির আওতায় ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২ হাজার ২৭টি ইউনিয়নে উঠান বৈঠক সম্পন্ন হয়েছে।