‘আনন্দে থাকার কথা ছিল, পেলাম স্ত্রী-সন্তানদের প্রাণহীন দেহ’
ছেলের বিয়ে চূড়ান্ত করতে ঢাকা থেকে শরীয়তপুরের গোসাইরহাটে এসেছিলেন শাহানা আক্তার (৫০)। মেঘনা নদীতে ট্রলারডুবিতে শাহানা, তাঁর মেয়ে জলি আক্তার (২০) ও ছেলে শাওন ব্যাপারীর মৃত্যু হয়েছে। আরেক ছেলে শান্ত ব্যাপারী (২৭) ও তাঁর বন্ধু হৃদয় এখনো নিখোঁজ আছেন। পরিবারটির সদস্যদের এমন মৃত্যু মানতে পারছেন না স্বজনেরা। স্ত্রী ও সন্তানদের হারিয়ে শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েছেন শাহানার স্বামী শাজাহান ব্যাপারী।
গতকাল শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টার শরীয়তপুরের গোসাইরহাটের মেঘনা নদীর মাঝেরচর এলাকা থেকে শাহানা ও তাঁর মেয়ের লাশ উদ্ধার করা হয়। রাত সাড়ে ৯টার দিকে তাঁর ছেলে শাওন ব্যাপারীর লাশ মেঘনার কুচাইপট্টি এলাকা থেকে জেলেরা উদ্ধার করে পুলিশের কাছে পৌঁছে দেয়।
শাহানা ঢাকার দক্ষিণ মুসন্ডি এলাকার শাজাহান ব্যাপারীর স্ত্রী। তিন স্বজনের নিথর দেহ নিয়ে শুক্রবার রাত ১২টার দিকে ঢাকায় ফিরেছেন শোকে স্তব্ধ শাজাহান।
শাহানা আক্তারের স্বজনেরা বলেন, শাজাহান ব্যাপারী স্ত্রী ও তিন সন্তানকে নিয়ে ঢাকার দক্ষিণ মুসন্ডি এলাকায় থাকতেন। তিনি একটি কোম্পানিতে নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজ করেন। এই দম্পতির ছেলে শান্ত ও শাওন দক্ষিণ মুসন্ডিতে মোটর যন্ত্রাংশের ব্যবসা করতেন। তিন সন্তান নিয়ে সুখেই দিন কাটছিল শাজাহান-শাহানা দম্পতির। তাঁদের বড় ছেলে শান্তর বিয়ে চূড়ান্ত করার জন্য বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা থেকে লঞ্চে করে শরীয়তপুরের গোসাইরহাটে আসেন। পরদিন শুক্রবার সকালে পরিবারের আট সদস্য কোদালপুর পুরোনো লঞ্চঘাট থেকে একটি ট্রলারে করে মেঘনার চর মাঝেরচর এলাকায় মেয়ের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হন। ট্রলারটি মেঘনা নদীর মাঝখানে পৌঁছালে স্রোত ও ঢেউয়ের কবলে পড়ে তা ডুবে যায়। তখন ট্রলারে ১১ জন যাত্রী ছিলেন। স্থানীয় জেলেরা ওই ট্রলারের আটজনকে উদ্ধার করেন। তাঁদের মধ্যে শাহানা ও তাঁর মেয়ে জলির মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ওই ঘটনায় শাহানার যে ছেলের বিয়ে করার কথা ছিল, সেই ছেলে শান্ত, তাঁর ছোট ভাই শাওন ও শান্তর বন্ধু হৃদয় পানিতে তলিয়ে স্রোতে ভেসে নিখোঁজ হন।
দুর্ঘটনার পর স্থানীয় প্রশাসন ট্রলার ও স্পিডবোট নিয়ে মেঘনা নদীর বিভিন্ন স্থানে নিখোঁজদের সন্ধান শুরু করে। দুপুর থেকে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল নিখোঁজদের সন্ধান শুরু করে। রাত সাড়ে ৯টার দিকে দুর্ঘটনাস্থল থেকে ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণে কুচাইপট্টি এলাকার মেঘনা নদী হতে জেলেরা শাওনের মরদেহ উদ্ধার করেন। আজ শনিবারও ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার অভিযান চলছে।
স্ত্রী ও সন্তানদের দুর্ঘটনার খবর শুনে ঢাকা থেকে গোসাইরহাটে ছুটে আসেন শাজাহান ব্যাপারী। শুক্রবার রাত ১১টার দিকে স্ত্রী ও দুই সন্তানের লাশ নিয়ে গোসাইরহাট থেকে ঢাকায় ফেরেন। প্রিয়জনের মৃত্যু ও নিখোঁজের ঘটনায় বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন তিনি।
শাজাহান ব্যাপারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার সংসার সুখে আর আনন্দে কানায় কানায় ভরে ছিল। ছেলের বিয়ে দিয়ে সেই সুখ আরও বাড়াতে চেয়েছিলাম। বড় ছেলের বিয়ে চূড়ান্ত করতে স্ত্রীক ও সন্তানদের পাঠিয়েছিলাম। আজ সবার আনন্দে থাকার কথা ছিল। আর আমি পেলাম স্ত্রী-সন্তানদের প্রাণহীন দেহ। আরেক ছেলের সন্ধানও পেলাম না। আমার সুখের ঘরটা এভাবে কান্নায় ভরে উঠবে, বুঝতে পারিনি। আমি ছাড়া কান্না করারও কেউ রইল না। আমি এখন কী নিয়ে বাঁচব?’
দুর্ঘটনাকবলিত ট্রলারে ছিলেন শান্তর দুই বন্ধু আকাশ ও হৃদয়। শান্তর সঙ্গে হৃদয় নিখোঁজ হন। আর আকাশকে উদ্ধার করে হোসাইরহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন আকাশ বলেন, ‘শান্ত ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা সাঁতার জানত না। ট্রলার ডুবে যাওয়ার পর আমাদের চিৎকারে নদীতে থাকা জেলে নৌকার মাঝিরা এগিয়ে এসে আমাদের উদ্ধার করেন। ততক্ষণে শান্তর মা ও বোন মারা যান। শান্ত, তাঁর ভাই শাওন ও আমাদের আরেক বন্ধু হৃদয় পানিতে তলিয়ে যায়। তাঁদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। আমরা এমন একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনার শিকার হব, তা কখনো কল্পনাও করতে পারিনি।’
গোসাইরহাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পুষ্পেন দেবনাথ প্রথম আলোকে বলেন, ট্রলার দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শাজাহান ব্যাপারী একটি অপমৃত্যু মামলা করেছেন। তাঁর স্ত্রী ও মেয়ের লাশ ময়নাতদন্ত করে ও ছেলের লাশ ময়নাতদন্ত ছাড়া হস্তান্তর করা হয়েছে। নিখোঁজ আরও দুজনের সন্ধান চলছে।
গোসাইরহাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আহমেদ সাব্বির সাজ্জাদ প্রথম আলোকে বলেন, শরীয়তপুরে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল নেই। তাই ফরিদপুর ও মাদারীপুর থেকে তাঁদের আনা হয়েছে। ট্রলার দুর্ঘটনায় নিখোঁজ দুই ব্যক্তিকে উদ্ধারের জন্য ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল মেঘনা নদীতে উদ্ধার অভিযান চালাচ্ছে।