বারবার পেশা বদলে ‘সিস্টেম’ করে চলছেন শরিফুল
জীবন-জীবিকাকে তছনছ করে দিয়েছিল করোনা পরিস্থিতি। তখন ঢাকায় ছোট একটা চাকরি করতেন শরিফুল। চাকরি হারিয়ে তাঁকে ঢাকা ছাড়তে হয়েছিল; ঠাঁই নিয়েছিলেন গ্রামের বাড়িতে। পরে শরিফুলের গন্তব্য হয় খুলনা শহর; তাঁর নতুন পরিচয় চা বিক্রেতা। ওই পেশায়ও টিকতে পারেননি তিনি; পেশা বদলাতে হয়েছে। রাজমিস্ত্রির সহযোগী হিসেবেও কাজ করেছেন। এখন অবশ্য শরিফুল ভ্যানে করে শহরের অলিগলিতে কলা বিক্রি করেন।
কলার ফেরিওয়ালা শরিফুল ইসলামের বয়স ৩৮ বছর। বাড়ি বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের কচুবুনিয়া গ্রামে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে নগরের নিরালা এলাকায় শরিফুলের সঙ্গে দেখা হয়। একটি বন্ধ দোকানের সামনে ভ্যানে কলা বিক্রি করছিলেন। ভ্যানে থরে থরে সাজানো সবরি, সাগর, চম্পা কলার ছড়া।
কথায় কথায় জানা গেল, ২০০৬ সালে মোরেলগঞ্জের সেলিমাবাদ ডিগ্রি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর শরিফুল স্নাতকে ভর্তি হন বাগেরহাটের সরকারি প্রফুল্ল চন্দ্র (পিসি) কলেজে। তবে আর্থিক অসংগতির কারণে পড়াশোনা এগিয়ে নেওয়া হয়নি। শরিফুলের বাবা একটা সরকারি দপ্তরের অফিস সহায়ক পদে চাকরি করতেন। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে বড় শরিফুল চাকরির সন্ধানে চলে যান রাজধানী শহরে। কম্পিউটার যন্ত্রাংশ বিক্রির দোকানে চাকরিও মেলে। এরপর কম্পিউটার যন্ত্রাংশ বিক্রির বেশ কয়েকটি দোকানে নানা পদে চাকরি করেছেন শরিফুল। ২০২০ সালে করোনার প্রকোপ শুরু হয়। করোনার ক্রান্তিকালে অনেকের মতো তাঁকে গ্রামে ফিরে আসতে হয়।
শরিফুল জানান, গ্রামে ফিরে কয়েক মাস বেকার বসে ছিলেন। কিন্তু বসে তো আর পেট চলে না। হাতেও তেমন টাকা ছিল না। ঢাকায়ও ফেরা হচ্ছিল না। খুলনায় থাকা একজন আত্মীয়র পরামর্শে শহরে ছোট একটা দোকান দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে নগরের মিস্ত্রিপাড়ায় একটা ছোট চায়ের দোকান শুরু করেন।
তবে ব্যবসাটা টিকিয়ে রাখতে পারেননি শরিফুল। এতে অবশ্য তাঁর নিজের দায় ছিল না। যে দোকান ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করতেন, সেই ভবন ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন মালিক। শরিফুলকে দোকান ছাড়তে হয়।
২০০৬ সালে মোরেলগঞ্জের সেলিমাবাদ ডিগ্রি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর শরিফুল স্নাতকে ভর্তি হন বাগেরহাটের সরকারি প্রফুল্ল চন্দ্র (পিসি) কলেজে। তবে আর্থিক অসংগতির কারণে পড়াশোনা এগিয়ে নেওয়া হয়নি।
শরিফুল বলেন, ‘নতুন করে দোকান খুঁজে পেলাম না। এরপর শুরু করলাম রাজমিস্ত্রির সহযোগীর কাজ। অনেক পরিশ্রম এ কাজে; আবার মনও পাওয়া যায় না। কাঁচামালের ব্যবসার চিন্তা করছিলাম। এরই মধ্যে আমাদের পাশের এলাকার একজন কলার আড়তদারের সঙ্গে কথা হলো। তিনি পরামর্শ দিলেন, “কলার ব্যবসা করো; লস নাই। এই দিয়ে ওপরে উঠতে পারবা।” কলার ব্যবসায় লেগে গেলাম। এখন দিন খারাপ যাচ্ছে না।’
প্রথম দিকে হাজার তিনেক টাকার কলা দিয়ে শুরু করেন শরিফুল। ভ্যান নেন আড়তদারের কাছ থেকে। দিন পনেরো পর নিজেই একটা পুরোনো ভ্যান কিনে ফেলেন। ফজরের নামাজের একটু পরেই আড়ত থেকে কলা কিনতে বের হতে হয় শরিফুলকে। সঙ্গে দুপুরের খাবারও নিয়ে আসেন। ছড়া হিসেবে কলা কিনে ডজনে বিক্রি করেন। পিটিআই মোড় থেকে নিরালাদিঘির পাড় পর্যন্ত এলাকায় বিভিন্ন দোকানে কলা দেন তিনি। মোড়ে মোড়ে আর গলিতে গিয়ে বিক্রি করেন কলা। নামাজের ওয়াক্তে কোনো মসজিদের সামনে থাকে তাঁর কলার ভ্যান।
কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে কলা কিনতে আসা ক্রেতার সঙ্গে দরদাম চলতে থাকে শরিফুলের। কেউ কেনেন, কেউ দামে না পড়ায় ফিরে যান। শরিফুল বলেন, ‘এই ব্যবসায় দোকানভাড়া, কারেন্ট বিল—কিছু লাগে না, এটা ভালো দিক। লাভ কম করে বিক্রি বেশির চেষ্টা করি। বিক্রি শেষ হতে আসর, মাগরিব, কখনো এশার ওয়াক্ত পার হয়ে যায়। বিক্রি শেষ করে যাইতে হয়। মাল রেখে দিলে কোয়ালিটি নষ্ট হয়; চালানো কষ্ট হয়।’
দুই মেয়েসন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে ভাড়া বাসায় শরিফুলের সংসার। কলার ব্যবসায় প্রতিদিন ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা লাভ থাকে। এই টাকার বেশির ভাগই জমানোর চেষ্টা করেন শরিফুল দম্পতি। এ জন্য অনেক কিছুর হিসাব আর কৌশল রপ্ত করে নিতে হয়েছে। শরিফুলের ভাষায় ‘সিস্টেম’ করে চালিয়ে নেওয়া।
কীভাবে খরচ কমিয়ে টাকা জমানো যায়, সে জন্য একটু সিস্টেম করে চলা লাগে। এখন ভালো আছি। মেয়েদের ভালো করে লেখাপড়াটা শেখাতে চাই। টাকা জমিয়ে বিদেশ যাওয়া চিন্তা আছে।শরিফুল ইসলাম, কলা বিক্রেতা
শরিফুলের কায়দা করে চালিয়ে নেওয়া বিষয়টা এ রকম—ছোট এক কক্ষের টিনশেডের বাসায় থাকেন তাঁরা। ভাড়া দেড় হাজার টাকা। ৪৫ টাকা কেজির মোটা চাল খান। প্রতিদিন আনাজপাতি কেনার সীমানা নির্ধারণ করে রেখেছেন ৫০ থেকে ৬০ টাকার মধ্যে। মাংস খাওয়া হয় না বললেই চলে। মাসে হয়তো একবার। মাঝেমধ্যে মাছ কেনেন; আর গ্রামে গেলে বাড়ি থেকে কিছু মাছ নিয়ে আসেন।
শরিফুল বলেন, ‘কীভাবে খরচ কমিয়ে টাকা জমানো যায়, সে জন্য একটু সিস্টেম করে চলা লাগে। এখন ভালো আছি। মেয়েদের ভালো করে লেখাপড়াটা শেখাতে চাই। টাকা জমিয়ে বিদেশ যাওয়া চিন্তা আছে।’ কোন দেশে যেতে চান জিজ্ঞাসা করতেই শরিফুল মুখে হাসির রেখা টেনে বলেন, ‘আগে তো টাকা জমাই; তারপর দেখা যাবে।’