‘চুরির অপবাদ ও কিস্তির যন্ত্রণায়’ গলায় ফাঁস, ১৬ দিন পর হাসপাতালে মৃত্যু অটোরিকশাচালকের
কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার অশ্বতলা গ্রামের আনোয়ার হোসেন (৩৫) পেশায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা (মিশুক) চালক। দুই সন্তান আর স্ত্রীকে নিয়ে টেনেটুনে ভালোই চলছিল তাঁর সংসার। হঠাৎ করে তাঁর বিরুদ্ধে চুরির অপবাদ ওঠে। একটি চালকল থেকে চাল চুরির অভিযোগে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি লাকসাম উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এবং বিএনপি নেতা মজির আহম্মেদের লোকজন তাঁকে ডেকে আনেন। নির্যাতন চালানো হয় আনোয়ারের ওপর।
এরপর সালিসে ওই বিএনপি নেতা আনোয়ারকে ‘চোর’ অ্যাখ্যা দিয়ে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। জরিমানার টাকা পরিশোধ করতে আনোয়ার একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেন। কিন্তু কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে না পারা আর চুরির অপবাদ সইতে না পেরে ৬ মার্চ গলায় ফাঁস দেন তিনি। এ ঘটনার পর ১৬ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে অবশেষে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন অটোরিকশাচালক আনোয়ার।
গতকাল বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত দুইটার দিকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় আনোয়ারের মৃত্যু হয়েছে। পরিবারের ভাষ্য, বিএনপি নেতা মজির আহম্মেদের দেওয়া চোর অ্যাখ্যা এবং কিস্তির টাকা দিতে না পেরে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন আনোয়ার, যার সর্বশেষ পরিণতি তাঁর মৃত্যু। আনোয়ার হোসেন অশ্বতলা গ্রামের প্রয়াত রঙ্গু মিয়ার ছেলে। কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে শুক্রবার সকালে তাঁর মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে।
মজির আহম্মেদ কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য। তিনি লাকসাম সদরের দৌলতগঞ্জ বাজার বণিক সমিতির আহ্বায়কের পদে রয়েছেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি মজির আহম্মেদের মালিকানাধীন লাকসাম পৌরসভার নশরতপুর এলাকায় অবস্থিত লাকসামে অটো রাইস মিলে (চালকল) ওই সালিস অনুষ্ঠিত হয়। মজির নিজেই ওই সালিসে রায় দেন। চাল চুরির ঘটনাটি ঘটেছে একই এলাকার আল-আমিন অটো রাইস মিলে। মজির আহম্মেদ ওই সালিসে অটোরিকশাচালক আনোয়ার হোসেনকে জরিমানা করেছেন বলে স্বীকার করেছেন।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে আল-আমিন অটো রাইস মিলে বেশ কিছু চাল চুরির ঘটনা ঘটে। চালকল কর্তৃপক্ষের দাবি, মিলের কয়েকজনের সঙ্গে চুরিতে যুক্ত ছিলেন অটোরিকশাচালক আনোয়ার। তাঁর মিশুকে করেই এসব চাল সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ওই সালিস করেন বিএনপি নেতা মজির।
শুক্রবার দুপুরে আনোয়ার হোসেনের ভাই দেলোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ভাইকে মজির আহম্মেদের লোকজন ওই মিলে চাল চুরির ঘটনায় সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য ডেকে নিয়ে যায়। এরপর সেখানে নিয়ে তাঁর ওপর নির্যাতন করে। পরে আমার ভাই চাল চুরি করেছে বলে তাঁকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। আমার ভাই মিশুক চালায়, ভাড়া দিলে সে যে কারও চাল পরিবহন করতে পারে। কিন্তু সে চোর ছিল না। মিথ্যা অভিযোগে আমার ভাইকে জরিমানা করা হয়। এরপর বাধ্য হয়ে সে কিস্তি নেওয়াসহ অনেক কষ্ট করে ৩২ হাজার টাকা পরিশোধ করে।’
দেলোয়ার হোসেন আরও বলেন, ‘কিস্তি নিয়ে জরিমানা দিলেও কিস্তির টাকা প্ররিশোধ করতে পারছিল না। ৬ আগস্ট কিস্তির লোকজন টাকার জন্য আসে, কিন্তু সে দিতে পারেনি। এরপর চোরের অপবাদ ও কিস্তির যন্ত্রণায় সেদিন দুপুরে আমার ভাই ঘরের মধ্যে গলায় ফাঁস দেয়। বাড়ির লোকজন বিষয়টি টের পেয়ে দ্রুত তাঁকে উদ্ধার করে লাকসাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে পরবর্তী সময়ে তাঁকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। বৃহস্পতিবার রাত দুইটার দিকে সেখানে আইসিইউতে মারা গেছে আনোয়ার। আমার ভাইয়ের দুইটা ছেলে এখনো ছোট। তাঁদের কী হবে ভেবে কূল পাচ্ছি না।’
আনোয়ারের এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন তাঁর স্ত্রী রোমানা বেগম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী চোর নয়। তিনি মিশুকচালক। কেউ ভাড়া দিলে চাল পরিবহন করে দেবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার স্বামীর ওপর অন্যায়ভাবে অত্যাচার করা হয়েছে। মজির আহম্মেদের লোকজন সাক্ষ্য দেওয়ার কথা বলে ডেকে নিয়ে প্রথমে তাঁকে রড দিয়ে পিটিয়েছে। এরপর মজির সাহেব নিজেই সালিসে রায় দিয়ে চোর হিসেবে আমার স্বামীকে জরিমানা করেন। তাঁর চোর অ্যাখ্যা দেওয়া মেনে নিতে পারেনি আমার স্বামী। সর্বশেষ কিস্তির যন্ত্রণায় গলায় ফাঁস দেন তিনি। আমি এখন কোথায় যাব, কার কাছে বিচার চাইব?’
এসব প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপি নেতা মজির আহম্মেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি বণিক সমিতির আহ্বায়ক হওয়ায় চুরি হওয়া মিলের মালিক আমার কাছে বিচার নিয়ে আসে। পরে প্রমাণিত হয় ওই মিশুকচালক ৪২ বস্তা চাল চুরি করেছে মিলের লোকজনের সঙ্গে মিলে। যার কারণে সালিসে তাঁকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। পরে ২০ হাজার টাকা তাঁদের গ্রামের সরদারের মাধ্যমে পরিশোধ করে, বাকি টাকার কথা জানি না। আমি যখন জেনেছি কিস্তির টাকা দিতে না পেরে সে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে, তখন আমি তার চিকিৎসার জন্য সহযোগিতা করেছি।’
কাউকে ডেকে এনে এভাবে বিচার করতে পারেন কি না, জানতে চাইলে মজির আহম্মেদ বলেন, ‘থানা–পুলিশে দিলে তো তার আরও বড় ক্ষতি হতো। যার কারণে সামাজিকভাবে বিচার করা হয়েছে। আমি বণিক সমিতির সভাপতি হওয়ায় এমন দরবারের জন্য মানুষ এসে বসে থাকে। আমি না চাইলেও সামাজিকতার কারণে বিচারে থাকতে হয়। সবকিছু তো আর চাইলেই পুলিশের কাছে পাঠানো যায় না। সে চুরি করেছে, এটা নিয়ে কোনো কথা নেই, আমি বিচার করেছি, এ নিয়েই কথা হচ্ছে।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে লাকসাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাজনীন সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ঘটনাটি জেনেছি। কুমিল্লা মেডিকেলে ওই মিশুকচালক মারা গেছেন। কোতয়ালি মডেল থানার মাধ্যমে সুরতহাল শেষে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। এ ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে এখনো কোনো লিখিত অভিযোগ আমাদের কাছে দেওয়া হয়নি। তাঁরা অভিযোগ দিলে আমরা মামলা নেব।’