কুমিল্লার বুড়িচং
ভাঙাচোরা একচালা ঘরে পাঠদান
জমির মালিকানা নিয়ে আদালতে মামলা চলছে। ফলে খাড়াতাইয়া পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন করা যাচ্ছে না।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির নাম ‘খাড়াতাইয়া পূর্ব পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’। কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার ষোলনল ইউনিয়নের খাড়াতাইয়া গ্রামে বিদ্যালয়টির অবস্থান। কয়েক বছর আগেও খাড়াতাইয়া ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা–সংলগ্ন স্থানে ছিল বিদ্যালয়টি। সেখানে এখন গাছগাছালিতে পূর্ণ। বিদ্যালয় ভবনের কোনো অস্তিত্ব নেই। বিদ্যালয়টি কোথায়, জিজ্ঞেস করতেই স্থানীয় বাসিন্দা আবুল হোসেন বললেন, ‘সড়কের পাশের বাড়ির ভেতরে যান। দেখবেন প্রথমেই একচলা ভাঙা একটি টিনের ঘর। সেখানেই এখন খাড়াতাইয়া পূর্ব পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।’
বিদ্যালয়টিতে ৮২ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। প্রধান শিক্ষকসহ বিদ্যালয়টিতে কর্মরত আছেন ছয়জন শিক্ষক। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে কোনো ভবন নেই। কুমিল্লা-বুড়িচং সড়কের উত্তর-পূর্ব পাশে খাড়াতাইয়া ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার বিপরীতে একটি বাড়িতে ভাঙাচোরা ওই একচালা টিনের ঘরে চলে পাঠদান। টিনের ঘরটির তিনটি কক্ষই নড়বড়ে। এর মধ্যেই শিক্ষকদের অফিস ও শ্রেণিকক্ষ। বিদ্যালয়টিতে নেই শৌচাগার ও নলকূপ। খেলার মাঠ তো অনেক দূরের কথা।
শিক্ষক ও স্থানীয় এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৯৩ সালে রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়। ২০১৩ সালে জাতীয়করণ করা হয়। মাদ্রাসা-সংলগ্ন তিন কক্ষবিশিষ্ট একতলা একটি ভবনে বিদ্যালয়টির পাঠদান চলে আসছিল। জাতীয়করণ হওয়ার পর বিদ্যালয়ের কার্যক্রমে গতি আসে। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার মান এবং ফলাফলও ছিল বেশ ভালো। এরই মধ্যে একতলা পাকা ভবনটি পরিত্যক্ত হয়। ২০২০ সালে বহুতল ভবন নির্মাণে ১ কোটি ৮ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। তখন পুরোনো পরিত্যক্ত ভবনটি দরপত্রের মাধ্যমে ভেঙে ফেলা হয়। ওই বছরই পুরোনো ভবনের জায়গায় নতুন ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। কিন্তু হঠাৎ কাজ বন্ধ হয়ে যায়। কারণ, স্থানীয় খাড়াতাইয়া গ্রামের বাসিন্দা প্রয়াত আবদুল হক ভূঁইয়ার ছেলে মাহফুজুর রহমান ভূঁইয়া বিদ্যালয়ের সম্পত্তি নিজেদের দাবি করে আদালতে মামলা করেন। মামলা নিষ্পত্তি না হলেও বিদ্যালয়েরভবনের জায়গাটি দখলে নিয়ে সেখানে বিভিন্ন ধরনের গাছ লাগিয়েছেন মাহফুজুর।
জানতে চাইলে মাহফুজুর রহমান ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার দাদা এই সম্পত্তিসহ আরও বেশ কিছু জায়গা মৌখিকভাবে মাদ্রাসাকে দান করে করেছিলেন। কিন্তু তিনি দানপত্র দলিল দেওয়ার আগেই মারা গেছেন। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় এলাকার বেশ কয়েকজন জাল দলিল করে এই সম্পত্তি বিদ্যালয়কে দান করেছিলেন, যা অবৈধ। এ জন্য আমি বিদ্যালয়ের ভবনটি যেই জায়গায় ছিল সেই ৫ শতক সম্পত্তি নিয়ে আদালতে মামলা করেছি। যদি আদালতে রায় আমার পক্ষে আসে তাহলে এই সম্পত্তি মাদ্রাসাকে দান করব। এতে আমার প্রয়াত দাদার আত্মা শান্তি পাবে।’
২০২১ সালে বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক নাছরিন আক্তার জানান, বর্তমানে যেই বাড়িতে টিনের ঘরে পাঠদান চলছে, সেই ঘরটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওপরে টিন এবং পাশে বাঁশের বেড়া দিয়ে নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। পরে বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা এবং এলাকাবাসী উদ্যোগ নিয়ে বেড়া পরিবর্তন করে টিন লাগিয়েছেন। জায়গা দিতে না পারায় ১ কোটি ৮ লাখ টাকার ভবনের বরাদ্দটি বাতিল হয়ে গেছে।
প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘বর্তমান টিনের ঘরটি অনেক আগেই ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। সামান্য বাতাসেও নড়তে থাকে। আর বৃষ্টি হলে তো আমাদের অস্তিত্ব থাকে না। বাচ্চাগুলোকে নিয়ে ছাতা মাথায় দিয়ে শিক্ষকেরা এক কোণে বসে থাকি। পুরো ঘরেই টিনের চাল দিয়ে পানি পড়ে। বাংলাদেশের কোথাও এমন দুর্ভোগের প্রাথমিক বিদ্যালয় আর আছে বলে আমার জানা নেই।’
বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী জিহাদ হোসেন বলে, ‘বৃষ্টির সময় আমরা ভয়ে থাকি। স্কুলের মাঠ নাই, আমরা খেলতে পারি না।’
বুড়িচং উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ফৌজিয়া আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুরো উপজেলার মধ্যে এমন দুরবস্থার বিদ্যালয় একটিও নেই। আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। যেই জায়গাটি নিয়ে মামলা চলছে সেটির ঝামেলা নিষ্পত্তি হতে সময় লাগলে আমরা পাশেই বিদ্যালয়ের আরেকটি জমিতে ভবন নির্মাণ করার প্রস্তাব পাঠিয়েছি।’