রাজশাহীতে শিশুদের স্যালাইনের তীব্র সংকট
সংকটের সুযোগে ৮৬ টাকার স্যালাইন ১ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
রাজশাহীতে শীতের আমেজ শুরু হয়েছে। এ সময়ে নিউমোনিয়াসহ শিশুদের নানা ধরনের রোগ বেড়ে গেছে। এ কারণে শিশুদের শিরায় দেওয়ার (আইভি) স্যালাইনের তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে। বেশির ভাগ হাসপাতালে শিশুদের স্যালাইন নেই। বাজারেও তীব্র সংকট রয়েছে। এই সংকটের সুযোগে ৮৬ টাকার স্যালাইন ১ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হচ্ছে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও ওষুধের দোকানমালিকেরা বলছেন, তাঁরা যেখান থেকে স্যালাইন কিনে থাকেন, সেই সব ডিলার স্যালাইন সরবরাহ করতে পারছেন না। বিকল্প জায়গা থেকেও স্যালাইন কিনতে পারছেন না। তাঁরা জানতে পারছেন, কোম্পানিগুলো স্যালাইনের উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গত অক্টোবর থেকে শিশুরা নিউমোনিয়া, ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। নভেম্বরেও সেটা অব্যাহত রয়েছে। হাসপাতালে এই দুই রোগে আক্রান্ত হয়ে গত অক্টোবরে দেড় হাজারের মতো শিশুকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। নভেম্বরে প্রতিদিন প্রায় ২০০ রোগী ভর্তি থাকছে। হাসপাতালের ২৪ নম্বর (শিশু) ওয়ার্ডের দুটি ইউনিট। একটি নিউমোনিয়ার, আরেকটি ডায়রিয়ার। নিউমোনিয়া ইউনিটে ২২ শয্যার বিপরীতে ৯০ জনের মতো শিশু চিকিৎসা নিচ্ছে।
কোম্পানিগুলো পর্যাপ্ত স্যালাইন দিচ্ছে না। এ কারণেই বেশি সংকট।মাহাবুব-ই আলম, সহসভাপতি, বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির রাজশাহী শাখা
চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের জন্য এপিএন স্যালাইনের ৫০০ এমএল, ১০০০ এমএল, ডিএনএস-১০ প্রয়োজন পড়ে। এই স্যালাইনগুলো দিতে পারলে শিশুদের জন্য ভালো হয়। শিশুরা দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে। তবে বিকল্প চিকিৎসাও আছে।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফ এম শামীম আহাম্মদ বলেন, হাসপাতালে স্যালাইন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ইডিসিএল (এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড)। গত অক্টোবরে সব ধরনের স্যালাইন মিলিয়ে তাদের কাছে ৪০ হাজার স্যালাইন চেয়েছিলেন; কিন্তু দিতে পারেনি।
ইডিসিএল এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এহসানুল কবির গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কোনো স্যালাইন উৎপাদন করি না। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে বাজার থেকে সংগ্রহ করে হাসপাতালে সরবরাহ করি। কিন্তু অনেক কোম্পানি পর্যাপ্ত সরবরাহ করতে পারছে না। সরকারের নির্দেশে আমরা ভারত থেকে আমদানি করছি। কারিগরি ও আনুষ্ঠানিকতার জটিলতায় সেটা আসতে দেড় মাস সময় লেগে যাচ্ছে।’
স্বাস্থ্য বিভাগের রাজশাহী বিভাগীয় পরিচালক আনোয়ারুল কবীর বলেন, সব জায়গায় স্যালাইনের টান আছে। কারণ, দেশে উৎপাদনই কম। কেউ স্টোর করছে কি না, সেটা দেখা দরকার।
শিশু রোগী বেড়েই চলেছে
গতকাল দুপুরে সরেজমিনে দেখা গেছে, ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের ভেতর থেকে শুরু করে বারান্দা, ওয়ার্ডের গেটের বাইরে সিঁড়ির পাশে শিশু রোগীদের নিয়ে স্বজনেরা বসে আছেন। স্বজনদের মধ্যে কেউ মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন, কেউ পট্টি (ভেজা কাপড়) দিচ্ছেন, কেউ আবার মাথায় পানি ঢেলে দিচ্ছেন।
নিউমোনিয়া ইউনিটের একটি শয্যায় চারটি শিশুর চিকিৎসা চলছে। সেখানে নওগাঁ থেকে আসা এক শিশুর অভিভাবক অভি রহমান বলেন, গত শুক্রবার হাসপাতাল থেকে একটি স্যালাইন লিখে দিয়ে আনতে বলা হয়। কিন্তু সেই স্যালাইন তিনি অনেক ঘোরাঘুরির পর পেয়েছেন। স্যালাইনের দাম ৮৬ টাকা লেখা থাকলেও তাঁকে ৮৫০ টাকা দিয়ে কিনতে হয়েছে।
২ মাস ১০ দিন বয়সের সন্তান তানভীরকে নিয়ে নওগাঁর আত্রাই থেকে এসেছেন তৃষা খাতুন ও মো. আমিনুল দম্পতি। ছয় দিন ধরে তাঁরা হাসপাতালের ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের বারান্দার বাইরে গেটের পাশে মেঝেতে থাকছেন। শিশুটি এখন অনেকটাই সেরে উঠেছে। তৃষা বলেন, এত বেশি শিশু এসেছে, অনেক অনুরোধ করেও তাঁরা শয্যা পাননি। তিনি বলেন, হাসপাতাল থেকে স্যালাইন দিতে পারছে না। তবে তাঁদের ভাগ্য ভালো, খুব বেশি স্যালাইন লাগেনি।
হাসপাতালের শিশু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের বিভাগীয় প্রধান (অতিরিক্ত) খন্দকার সাইফুল ইসলাম বলেন, শীতে শিশুদের নিউমোনিয়া, ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়ে যায়। এবারও বেড়ে গেছে। দেখা গেছে, ইউনিটে ২২টি শয্যা আছে, সেখানে ২২ জন শিশুর চিকিৎসা দেওয়ার প্রয়োজন। কিন্তু সেখানে প্রায় ১০০ শিশুকে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে।
দোকানে স্যালাইন নেই
নগরের লক্ষ্মীপুর এলাকায় কয়েকটি ফার্মেসি ঘুরে দেখা গেছে, শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় এপিএন স্যালাইন নেই। দুটি ফার্মেসিতে বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারে স্যালাইন নেই বললেই চলে।
ঔষধ ভান্ডার ফার্মেসির বিক্রয়কর্মী মো. আবদুল্লাহ বলেন, স্যালাইন কিনতে আসেন অনেকেই; কিন্তু স্যালাইন নেই। অনেকের কাছেই অল্পসংখ্যক আছে। তাঁরাই বেশি টাকায় বিক্রি করছেন। তিনি আরও বলেন, ওষুধ কোম্পানিগুলো শিশুদের জন্য তৈরি স্যালাইন দিচ্ছে না। পাঁচটি স্যালাইন দিলে তার সঙ্গে অপ্রচলিত অন্য ওষুধের প্যাকেজ ধরিয়ে দিচ্ছে।
বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির রাজশাহী শাখার সহসভাপতি মাহাবুব-ই আলম বলেন, কোম্পানিগুলো পর্যাপ্ত স্যালাইন দিচ্ছে না। এ কারণেই বেশি সংকট। তাঁরা দফায় দফায় সভা করছেন, চিঠি দিচ্ছেন। কিন্তু কাজ হচ্ছে না। আবার কৃত্রিম সংকট অনেকে তৈরিও করে থাকতে পারেন। তা না হলে একটি ৭০ থেকে ৯০ টাকার স্যালাইন ৩০০-৪০০ টাকায় বিক্রি করবে কেন? তাঁরা ওষুধ কোম্পানিগুলোতে চাপ দিয়ে যাচ্ছেন, যাতে তারা সরবরাহ বাড়ায়।