সুন্দরবনে প্রবেশের অনুমতিপত্র নবায়নে রাজস্বের চেয়ে ৪০ গুণ ঘুষ আদায়
সুন্দরবনের বনজীবী জেলেদের নৌকা নিয়ে বনে প্রবেশের অনুমতিপত্র (বিএলসি) নবায়ন করতে দায়িত্বরত বন কর্মকর্তারা সরকার নির্ধারিত রাজস্বের বাইরে ঘুষ আদায় করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বনকর্মীদের হয়রানি থেকে বাঁচতে এবং নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার ও কাঁকড়া ধরার অলিখিত অনুমতি পেতে জেলেরা বাধ্য হয়ে ঘুষ দিয়ে বনে প্রবেশ করেন।
বনজীবী জেলেরা বলছেন, অনুমতিপত্র নবায়নে সরকার প্রতি ২৫ মণ ধারণক্ষমতার একটি নৌকার জন্য ১৫ টাকা পর্যন্ত রাজস্ব নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু বন বিভাগের দায়িত্বরত কর্মকর্তারা তাঁদের কাছ থেকে ৬০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করছেন, যা সরকার নির্ধারিত রাজস্বের কমপক্ষে ৪০ গুণ বেশি।
বনজীবীরা বলেন, সুন্দরবনের কালাবগী স্টেশন কর্মকর্তা ইস্তিয়াক রহমান, নলীয়ান স্টেশন কর্মকর্তা তানজিলুর রহমান, বানিয়াখালী স্টেশন কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম, কোবাদক স্টেশন কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন, ঢাংমারী স্টেশন কর্মকর্তা মোহসীন আলী প্রতিটি অনুমতিপত্র থেকে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত ঘুষ আদায় করছেন। আর কাশিয়াবাদ স্টেশন কর্মকর্তা নির্মল কুমার প্রতিটি অনুমতিপত্র থেকে ৬০০ টাকা ঘুষ আদায় করছেন।
সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল বনজীবী জেলেরা বনের নদী ও খালে মাছ, কাঁকড়া শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করেন। প্রজনন মৌসুম হওয়ায় জুন থেকে আগস্ট মাসের শেষ পর্যন্ত সুন্দরবনে জেলেদের প্রবেশ বন্ধ রেখেছিল বন বিভাগ। ১ সেপ্টেম্বর থেকে পুনরায় মাছ ও কাঁকড়া ধরার অনুমতি দেওয়ায় বন বিভাগ থেকে জেলে নৌকার বিএলসি নবায়ন করতে হচ্ছে।
বানিয়াখালী ফরেস্ট স্টেশন ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, তিনটি নৌকা নিয়ে বনে প্রবেশের অনুমতিপত্র নিতে এসেছেন জেলে তেজন বৈদ্য, সবুজ মণ্ডল ও পবিত্র মণ্ডল। তাঁরা জানালেন, তিনজনেরই বনের কাঁকড়া ধরার অনুমতিপত্র আছে। এ বছর অনুমতিপত্র নবায়নে বানিয়াখালী ফরেস্ট স্টেশনের কর্মকর্তারা প্রত্যেকের কাছ থেকে এক হাজার টাকা করে নিয়েছেন। তাঁরাও এ টাকা দিয়েছেন। তাঁদের একজন বলেন, ‘আমাদের বনবাদার করে খেতে হয়। যত টাকা লাগুক না কেন, বনে আমাদের যেতেই হবে। বনে না গেলে খাব কী? সংসার চালাবে কীভাবে?’
বানীখালী গ্রামের বাসিন্দা চন্দ্রকান্ত মণ্ডল বলেন, ‘৩০ বছর ধরে সুন্দরবনে মাছ কাঁকড়া মেরে সংসার চালাই। গত বছর থেকে বানিয়াখালী ফরেস্ট স্টেশনে বাৎসরিক অনুমতিপত্র নবায়নে ১০০০ টাকা করে নিচ্ছে। অথচ অনুমতির কাগজে লেখা ২৫ টাকা। গরিব মানুষের নালিশ করারও জায়গা নেই। সুন্দরবনে ঢোকার পর বনরক্ষীদের হয়রানির ভয়ে বন বিভাগের চাহিদা মতো টাকা দিয়েই অনুমতি নিয়েছি।’
রাজস্বের সাড়ে ২৭ টাকার পরিবর্তে ঘুষ হিসেবে এক হাজার টাকা নেওয়ার প্রচলন বানিয়াখালী ফরেস্ট স্টেশনের সাবেক কর্মকর্তা আবু সাঈদ শুরু করেন বলে জানান বানিয়াখালী গ্রামের জেলে অলক কুমার বৈদ্য।
অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন বন কর্মকর্তা আবু সাঈদ নিজেও। তিনি বর্তমানে সুন্দরবনের কাগাদোবেকী টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার বিষয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজস্বের বেশি টাকা নেওয়া হয়, এটা ঠিক। তবে জেলেদের কাছ থেকে জোর করে নেওয়া হয় না। টাকা দিতে জেলেরা আপত্তিও করেন না। আমরাও জেলেদের সুযোগ-সুবিধা দেখি। জেলেরা নিষিদ্ধ জাল, বরফ, দা-কুড়াল নিয়ে বনে ঢোকে, আমরা দেখেও দেখি না।’
সুন্দরবন–সংলগ্ন কয়রা উপজেলার হড্ডা গ্রামের বনজীবী জেলে নেপাল মিস্ত্রি বলেন, ‘আমাদের গ্রামের অধিকাংশ জেলে নৌকার অনুমতিপত্র নেওয়া হয়েছে সুন্দরবনের নলীয়ান ফরেস্ট স্টেশন থেকে। আমাদের কাছ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা করে নিয়েছেন বন কর্মকর্তারা। আমি নিজে গ্রামের ১৫ জন জেলের অনুমতিপত্র নবায়ন করেছি নলীয়ান স্টেশন থেকে। প্রথমে ১৫ জেলের ১৫ হাজার টাকা দিলেও অফিসের খাতায় প্রত্যেক জেলের নামে দুই শ টাকা বাকি লিখে রেখেছে। সরকারের ঘরে এক একটা নৌকায় সর্বোচ্চ ৫০ টাকা জমা দেন। বাকি টাকা বন কর্মকর্তারা নিজেরা নেন।’
নলীয়ান ফরেস্ট স্টেশন কর্মকর্তা তানজিলুর রহমান বলেন, ‘আমরা ওই এক হাজার টাকা করেই নিয়েছি, এটা সত্য। তবে অনেক গরিব জেলেদের নিকট থেকে টাকাই নেওয়া হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে এভাবেই চলে আসছে। তবে এই সংস্কৃতি থেকে বের হওয়া দরকার।’
সুন্দরবনের কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশন থেকে বনে প্রবেশের অনুমতিপত্র নবায়ন করেছেন কয়রার জেলে শহিদুল ইসলাম, গফুর সরদার, কামরুল ইসলাম ও শহিদুল গাজী। তাঁরা জানান, কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশন থেকে বিএলসি নবায়নে প্রতিটি জেলে নৌকার জন্য ৬০০ টাকা করে নেওয়া হয়েছে। তাঁরা গরিব মানুষ, বন কর্মকর্তারা যা চান, তাই দিতে হয়। না হলে বনের মধ্যে নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়।
কাশিয়াবাদ স্টেশন কর্মকর্তা নির্মল কুমার বলেন, ‘অন্য স্টেশনগুলোর তুলনায় আমার এখানে টাকার পরিমাণ কম। আমি মাত্র ৬০০ টাকা নিচ্ছি। তবে তিন মাস সুন্দরবন বন্ধ ছিল। বনরক্ষীরা দোকানপাটে বাকিতে মালামাল কিনেছিলেন, এখন এই টাকা নিয়ে দোকানের দেনা শোধ করা হচ্ছে। এ ছাড়া আমাদের বোটে টহলের জন্য যে পরিমাণ তেল দেওয়া হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি তেল খরচ হয়। আমরা সেটাও বিএলসি নবায়ের আদায় করা অতিরিক্ত টাকা থেকে খরচ করি। জেলেরা স্বেচ্ছায় এই টাকা দেন।’
বছরে ঘুষ আদায় সাড়ে ৩৮ লাখ টাকা
সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল অন্তত ৫০ জন জেলের অনুমতিপত্রে দেখা গেছে, সেগুলোতে ৪০ টাকার নিচে রাজস্ব নেওয়া হয়েছে বলে লেখা আছে। তবে জেলেদের সবাই জানিয়েছেন, তাঁরা দায়িত্বরত বন কর্মকর্তাদের এক হাজার টাকা করেই দিয়েছেন। সুন্দরবনের কয়েকটি ফরেস্ট স্টেশনে খোঁজ নিয়ে রাজস্বের কয়েক গুণ বেশি ঘুষ গ্রহণের চিত্র উঠে এসেছে।
সুন্দরবনের নলীয়ান ফরেস্ট স্টেশন থেকে ১ সেপ্টেম্বরের আগপর্যন্ত ৮৪৩টি জেলে নৌকার অনুমতিপত্র নবায়ন হয়েছে। কোবাদক স্টেশন থেকে ৮৮০টি, বানিয়াখালী স্টেশন থেকে ৫১১টি, কালাবগী স্টেশন থেকে ৫০৫টি, ঢাংমারী স্টেশন থেকে ৪৩০টি ও কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশন থেকে ৮৭৫টি জেলে নৌকার অনুমতিপত্র নবায়ন হয়েছে।
সুন্দরবনের জেলেদের বেশির ভাগ মাছ ও কাঁকড়া আহরণের নৌকার ধারণক্ষমতা স্বাভাবিকভাবে ৭৫ মণ পরিমাপের হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে সরকারি মূল্য অনুযায়ী প্রতিটি নৌকায় রাজস্ব দাঁড়ায় ৪৫ টাকা থেকে ৫০ টাকা। সে হিসাবে উল্লেখিত ফরেস্ট স্টেশনগুলোর মোট ৪ হাজার ৪৪টি নৌকার নবায়ন থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছে ২ লাখ ২ হাজার ২০০ টাকা। আর জেলেদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী প্রতিটি নৌকায় এক হাজার টাকা করে নিলে ঘুষ আদায় হয়েছে ৩৮ লাখ ৪১ হাজার ৪০০ টাকা।
ঘুষের টাকার ভাগ পান উর্ধ্বতনরাও
বন বিভাগের কয়েকজন স্টেশন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, জেলেদের বনে প্রবেশের অনুমতিপত্র নবায়নে যে বেশি টাকা নেওয়া হয়, তার ভাগ ঊর্ধ্বতন বন কর্মকর্তারাও পান। এ কারণে বেশি টাকা নেওয়ার বিষয়টি কয়েক যুগ ধরে চলে এলেও কখনো বন্ধ হয়নি। গত বছর কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নৌকার অনুমতিপত্র নবায়নে রাজস্বের বেশি ঘুষ আদায় করায় মামলা দিয়েছিলেন কয়েকজন জেলে। সেটিও মীমাংসা হয়ে গেছে।
একাধিক জেলের ভাষ্য, অতিরিক্ত টাকা না দিলে বিএলসি নবায়ন করা হয় না। উল্টো মামলায় জড়িয়ে হয়রানির ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করেন বনরক্ষীরা। এ কারণে তাঁরা ঊর্ধ্বতন মহলেও জানাতে সাহস পান না।
সুন্দরবন খুলনা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক এ জেড এম হাছানুর রহমান বলেন, জেলেদের বিএলসি নবায়নে নিয়মে যা আছে, তাই নেওয়ার জন্য প্রতিটি ফরেস্ট স্টেশন কর্মকর্তাকে নির্দেশ দোওয়া হয়েছিল। কারও বিরুদ্ধে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এসব অনিয়ম ও দুর্নীতিতে তিনি এবং ঊর্ধ্বতন বন কর্মকর্তারা জড়িত নন বলে দাবি করেন।