সরকারি বিদ্যালয়ে চলছে কিন্ডারগার্টেন

  • কিন্ডারগার্টেনটি থেকে সরকারি বই দেওয়া হলেও প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে বইয়ের জন্য নেওয়া হয় ৭৫০ টাকা।

  • বর্তমান শিক্ষার্থীর সংখ্যায় সব মিলিয়ে কিন্ডারগার্টেনটি থেকে বছরে আয় প্রায় ১৬ লাখ ২৯ হাজার টাকা।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সরকারি উচ্চবিদ্যালয় চত্বরে কিন্ডারগার্টেন (ডানে)। গত রোববার সকালে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা ত্রিমোড় এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

সরকারি বিদ্যালয়ের সীমানার ভেতরে কিন্ডারগার্টেন চালানোর কোনো নিয়ম নেই। কিন্তু এই নিয়ম লঙ্ঘন করে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা ত্রিমোড় এলাকায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের মধ্যে কিন্ডারগার্টেন চালানো হচ্ছে। নানা কৌশল অবলম্বন করে ও গোপনীয়ভাবে বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে ১৭ বছর ধরে কিন্ডারগার্টেন পরিচালনা করছেন উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।

কিন্ডারগার্টেন পরিচালনার জন্য কারও অনুমোদন নেওয়া হয়েছিল কি না তা জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক ও কিন্ডারগার্টেনের পরিচালক আনন্দ কুমার দাস প্রথম আলোকে বলেন, হাইস্কুলটি সরকারি হওয়ার আগে থেকেই কিন্ডারগার্টেনটি ছিল, তাই আর বন্ধ করা হয়নি। এর জন্য কারও কাছ থেকে কোনো অনুমোদনও নেওয়া হয়নি।

উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা রমিতা ইসলাম বলেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের ভেতরে কিন্ডারগার্টেন চালানোর নিয়ম নেই। ওই কিন্ডারগার্টেনের জন্য তাঁদের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া হয়নি। আর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জাকির মোল্লা বলেন, সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের মধ্যে সরকারি বেতনভুক্ত শিক্ষকের কিন্ডারগার্টেন পরিচালনা করার বিষয়টি তাঁদের জানা ছিল না। তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কিন্ডারগার্টেন থেকে যা আয় হয়, তা সরকারি বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক আনন্দ কুমার দাস ও তাঁর কয়েকজন সহকর্মী ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নেন।

স্থানীয় বাসিন্দা ইউছুব আলী, ‘আমাদের এত কাছের একটি স্কুল অথচ আমরা জানতাম না তাঁরা একই স্কুলের ক্লাসরুম কিন্ডারগার্টেন হিসেবে ব্যবহার করছেন। প্রধান শিক্ষক সরকারি বেতন পাচ্ছেন। আবার একই বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষ ব্যবহার করে কিন্ডারগার্টেন চালাচ্ছেন।’

এলাকাবাসী, বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা ত্রিমোড় এলাকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সরকারি উচ্চবিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯৮ সালে। এমপিওভুক্ত হয় ২০১০ সালে। ২০১৬ সালে জাতীয়করণ হয়। বাড়তি আয় করতে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আনন্দ কুমার দাসের পরিচালনায় কয়েকজন সহকারী শিক্ষক মিলে ২০০৫ সালে বিদ্যালয়ের চত্বরে ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু স্কুল’ নামে কিন্ডারগার্টেন চালু করেন। এ জন্য তাঁরা মূল বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষ ব্যবহার করছেন।

একই দরজির দোকানে সরকারি উচ্চবিদ্যালয় ও কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষার্থীদের পোশাক তৈরি হওয়ায় কিন্ডারগার্টেন শিক্ষার্থীদের পোশাকে সরকারি বিদ্যালয়ের নাম ও লোগো জুড়ে দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেন কিন্ডারগার্টেনের সহকারী শিক্ষক সাজেদা বেগম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘কিন্ডারগার্টেন আনন্দ স্যার (আনন্দ কুমার দাস) নিজেই দেখাশোনা করেন। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা তুলে তাঁর কাছে জমাসহ যাবতীয় হিসাব-নিকাশ দেওয়া হয়।’

আমাদের এত কাছের একটি স্কুল অথচ আমরা জানতাম না তাঁরা একই স্কুলের ক্লাসরুম কিন্ডারগার্টেন হিসেবে ব্যবহার করছেন। প্রধান শিক্ষক সরকারি বেতন পাচ্ছেন। আবার একই বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষ ব্যবহার করে কিন্ডারগার্টেন চালাচ্ছেন।
ইউছুব আলী, স্থানীয় বাসিন্দা

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই কিন্ডারগার্টেনে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৪৫। তাদের কাছ থেকে গড়ে ৩০০ টাকা করে মাসিক বেতন নেওয়া হয়। সেই হিসাবে বেতন থেকে মাসে আয় ৭৩ হাজার ৫০০ টাকা, বছরে ৮ লাখ ৮২ হাজার টাকা। ভর্তি ও সেশন ফি বাবদ প্রতিবছর জনপ্রতি নেওয়া হয় ১ হাজার টাকা। এই খাতে বছরে আয় প্রায় ২ লাখ ৪৫ হাজার টাকা।

শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা জানান, কিন্ডারগার্টেন থেকে সরকারি বই দেওয়া হলেও প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে বইয়ের জন্য নেওয়া হয় ৭৫০ টাকা। এই হিসাবে ২৪৫ জন শিক্ষার্থীর কাছে বই বিক্রি বাবদ আয় দাঁড়ায় প্রায় ১ লাখ ৮৩ হাজার। এ ছাড়া বছরে নেওয়া হয় চারটি পরীক্ষা। প্রতিটি পরীক্ষায় প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ফি দিতে হয় ২৫০ টাকা। একটি পরীক্ষা থেকে আসে ৬১ হাজার ২৫০ টাকা। চারটি পরীক্ষার ফি থেকে আয় ২ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। বর্তমান শিক্ষার্থীর সংখ্যায় সব মিলিয়ে কিন্ডারগার্টেনটি থেকে বছরে আয় প্রায় ১৬ লাখ ২৯ হাজার টাকা।

সরকারি বিদ্যালয়ের পাশাপাশি কিন্ডারগার্টেন পরিচালনার কথা স্বীকার করে আনন্দ কুমার দাস বলেন, এত টাকা নেওয়া হয় না। তার মধ্যে সেখানে আলাদা করে আরও পাঁচজন শিক্ষক রাখা হয়েছে। তাঁদের বেতন দিতে হয়। এ ছাড়া তিনি একা নন, আরও কয়েকজন শিক্ষক তাঁর সঙ্গে মালিক হিসেবে আছেন।

কিন্ডারগার্টেনে আলাদাভাবে শিক্ষক হিসেবে আছেন সাজেদা বেগম, হোসনে আরা, রেবেকা সুলতানা, শারমিন বেগম, দীপালি রায়। তাঁদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁদের বেতন ছয় থেকে সাড়ে ছয় হাজার টাকা। যে টাকা আয় হয়, তার অল্পই ব্যয় কিন্ডারগার্টেন পরিচালনায়।

সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে কিন্ডারগার্টেন পরিচালনার বিষয়ে কালিয়াকৈর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাজওয়ার আকরাম সাকাপি ইবনে সাজ্জাদ বলেন, বিষয়টি তদন্ত করতে মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সত্যতা পাওয়া গেলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।