বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস
তথ্যের অভাবে বাড়ছে ঝুঁকি
বরিশাল বিভাগের হাসপাতালে রোগ নির্ণয়ের ব্যবস্থা না থাকা, সচেতনতার অভাব ও উদাসীনতার কারণে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।
মোস্তাফিজুর রহমানের বিয়ে হয় ২০০৪ সালে। বিয়ের পর স্ত্রীসহ নিজের শারীরিক জটিলতা না থাকায় তাঁরা জানতেন না দুজনই থ্যালাসেমিয়ার বাহক। ২০০৭ সালে তাঁদের প্রথম সন্তানের জন্ম হয়। তবে বিপত্তি বাধে দ্বিতীয় মন্তান ছেলের জন্মের সময়। তিন মাস বয়সে ওই ছেলের তীব্র জ্বর হয়। চিকিৎসা দিয়েও জ্বর নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছিল না। পরে শিশুবিশেষজ্ঞর পরামর্শে ছেলেকে ঢাকায় নিয়ে পরীক্ষা করালে থ্যালাসেমিয়া ধরা পড়ে। পরে পরীক্ষা করে জানতে পারেন, নিজেরা থ্যালাসেমিয়ার বাহক।
বরগুনার আমতলী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যখন বিয়ে করি, তখন এই রোগের নাম কেউ জানত না। এ জন্য ওই সময় পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিনি। জীবনের ছোট একটি ভুল কত বড় বিপর্যয় ঘটাতে পারে, সেটা সন্তানের চিকিৎসা করাতে গিয়ে এখন টের পাচ্ছি।’
চিকিৎসকেরা বলছেন, থ্যালাসেমিয়া প্রচ্ছন্ন জিনঘটিত বংশগত একটি রোগ। এর ফলে রক্তে অক্সিজেন পরিবহনকারী হিমোগ্লোবিন কণার উৎপাদনে ত্রুটি থাকে। থ্যালাসেমিয়া রোগী সাধারণত রক্তে অক্সিজেন স্বল্পতায় (অ্যানিমিয়া) ভোগেন।
বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলে থ্যালাসেমিয়া রোগীর সংখ্যা প্রতিবছর বাড়ছে বলে স্বাস্থ্য বিভাগের ধারণা। এ–সংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় এর যথাযথ চিত্র পাওয়া যায়নি। এ রোগের বিষয়ে মানুষের সচেতনতা কম। জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে রোগ নির্ণয়ের ব্যবস্থা না থাকা, সচেতনতার অভাব ও উদাসীনতার কারণে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।
* থ্যালাসেমিয়া প্রচ্ছন্ন জিনঘটিত বংশগত রোগ। এর ফলে রক্তে অক্সিজেন পরিবহনকারী হিমোগ্লোবিন কণার উৎপাদনে ত্রুটি থাকে। * থ্যালাসেমিয়া রোগী সাধারণত রক্তে অক্সিজেন স্বল্পতায় ভোগেন।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানান, থ্যালাসেমিয়া রোগ নির্ণয়ে হেমাটোলজি অটো অ্যানালাইজার মেশিনে রক্তের সিবিসি পরীক্ষায় থ্যালাসেমিয়া বাহকের ধারণা পাওয়া যায়। এরপর হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফোরেসিস পরীক্ষা করে থ্যালাসেমিয়া বাহক কি না নিশ্চিত হওয়া যায়। তবে ক্ষেত্রবিশেষে ডিএনএ অ্যানালাইসিস পরীক্ষাও করা লাগে। বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ ছাড়া বরিশাল বিভাগের অন্য কোনো হাসপাতালে থ্যালাসেমিয়া নির্ণয়ের ব্যবস্থা নেই।
বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, থ্যালাসেমিয়া রোগ নির্ণয় ও রোগীর ওষুধপত্র বিনা মূল্যে তাঁদের হাসপাতাল থেকে সরবরাহ করা হয়। তিনি বলেন, প্রতিবছর কত রোগী আসে, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। শিগগিরই তাঁরা তথ্য সংরক্ষণের উদ্যোগ নেবেন।
বিভাগীয় পর্যায়ে থ্যালাসেমিয়া রোগীর কোনো তথ্য-উপাত্ত না থাকলেও গত কয়েক বছরে রোগটির ব্যাপক বিস্তারের ধারণা পাওয়া যায় বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (বিআরএফ) একটি গবেষণা প্রতিবেদনে। ২০১৭ সালে করা গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের শতকরা ১০ থেকে ১২ শতাংশ মানুষ থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক। অর্থাৎ প্রায় দেড় থেকে দুই কোটি মানুষ। বর্তমানে এ সংখ্যা আরও বেড়েছে বলে মনে করেন অনেকে।
বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক (প্রশাসন) শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, ব্যক্তিগত চেম্বারে এখন প্রায়ই থ্যালাসেমিয়া রোগী আসছে। উপসর্গ নিয়ে আসা রোগী শনাক্তের সংখ্যা বাড়ছে। নীরবে রোগটির বিস্তৃতি ঘটছে বলে তাঁদের ধারণা। থ্যালাসেমিয়া মূলত জিনগত রোগ। সচেতনতার মাধ্যমে এটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। বিয়ের আগে ছেলে–মেয়ে উভয়ে থ্যালাসেমিয়ার বাহক কি না, সেটা পরীক্ষা করলে পরবর্তী প্রজন্মকে এ রোগ থেকে সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব। তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা অচিরেই থ্যালাসেমিয়া রোগীর তথ্য সংগ্রহ করার উদ্যোগ নেব। একই সঙ্গে সব হাসপাতালের স্বাস্থ্য শিক্ষা কার্যক্রমে রোগটি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
চিকিৎসা
সাধারণত রক্তস্বল্পতার জন্য একজন থ্যালাসেমিয়া রোগীকে প্রতি মাসে ১ থেকে ২ ব্যাগ রক্ত দিতে হয়। ঘন ঘন রক্ত নেওয়ায় ও পরিপাকনালি থেকে আয়রনের শোষণক্ষমতা বেড়ে যাওয়ায় শরীরে আয়রনের মাত্রা বেড়ে যায়। নিয়মিত রক্ত দিয়ে সঠিকভাবে চিকিৎসা করালে থ্যালাসেমিয়া রোগীকে দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব।
চিকিৎসকদের পরামর্শ
বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন, হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ (প্রেষণ) এম কে আজাদ বলেন, একজন সুস্থ মানুষ যে কাউকে (রোগী বা বাহক) বিয়ে করতে পারবেন। কারণ, তাঁদের সন্তানের রোগী হওয়ার আশঙ্কা নেই। তবে একজন বাহক আরেকজন বাহককে বিয়ে করলে তাঁদের সন্তানের রোগী হওয়ার ঝুঁকি ২৫ ভাগ।