আড়াই বছরেও চালু হয়নি মহারাজা স্কুল ট্র্যাজেডি নিয়ে নির্মিত স্মৃতিসৌধ জাদুঘর

দিনাজপুরে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে মহারাজা স্কুল প্রাঙ্গনে নির্মিত স্মৃতিসৌধ জাদুঘর আড়াই বছরেও চালু হয়নি। সম্প্রতি তোলা ছবি
ছবি: প্রথম আলো

১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারি দিনাজপুর শহরের বালুবাড়ি এলাকায় মহারাজা গিরিজানাথ স্কুলে মাইন বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। বিজয়ের মাত্র ২১ দিনের মাথায় স্কুলে মুক্তিযোদ্ধা ট্রানজিট ক্যাম্পে মাইন বিস্ফোরণে নিহত হন পাঁচ শতাধিক বীর মুক্তিযোদ্ধা।

শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি রক্ষায় বিদ্যালয়–সংলগ্ন একটি স্মৃতিসৌধ জাদুঘর ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু আড়াই বছরেও শুরু হয়নি কোনো কার্যক্রম। ফলে অযত্ন–অবহেলায় পড়ে আছে এই স্থাপনা।

স্থানীয় প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ২০২০ সালে স্কুল–সংলগ্ন স্থানে ৬ জানুয়ারি শহীদদের উদ্দেশে স্মৃতিসৌধ জাদুঘর নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিশেষ প্রকল্প ‘মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্থানসমূহ সংরক্ষণ ও মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণ’ প্রকল্পের আওতায় ৬২ লাখ ৮ হাজার টাকা ব্যয়ে স্থানীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সূচনা ট্রেডার্স ২০২২ সালে এর নির্মাণকাজ শেষ করে। ওই বছরই এটি মহারাজা স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়। অন্যদিকে দিনাজপুর গণপূর্ত বিভাগ সূত্র জানায়, স্মৃতির মিনারটির প্রাক্কলিত নির্মাণ ব্যয় ছিল ১ কোটি ৮৪ লাখ টাকা।

দিনাজপুর মহারাজা স্কুল মাইন বিস্ফোরণ ট্র্যাজেডি স্মৃতি পরিষদের আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল হক প্রথম আলোকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধে দিনাজপুরের এত বড় একটি ঘটনা বর্তমান প্রজন্মের অনেকের অজানা। দীর্ঘ সময় পরে স্মৃতি সংরক্ষণে একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আড়াই বছর পার হয়ে গেছে কিন্তু কাজকর্ম চোখে পড়ছে না। স্মৃতি সংরক্ষণের নমুনা সংগ্রহ ও সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কোনো জনবলও নিয়োগ করা হয়নি।

৬২ লাখ ৮ হাজার টাকা ব্যয়ে স্থানীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সূচনা ট্রেডার্স ২০২২ সালে স্মৃতিসৌধ জাদুঘর নির্মাণকাজ শেষ করে। দিনাজপুরের মহারাজা স্কুল প্রাঙ্গনে
ছবি: প্রথম আলো

১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারির মাইন বিস্ফোরণের ঘটনার বর্ণনায় কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা জানান, দিনাজপুর হানাদারমুক্ত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর রাতে। যুদ্ধ শেষে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে আপন ঠিকানায় ফিরতে শুরু করেছিলেন অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা। শহরের বালুবাড়ি এলাকায় মহারাজা গিরিজানাথ স্কুল ভবনে করা হয় মুক্তিযোদ্ধা ট্রানজিট ক্যাম্প। যুদ্ধ–পরবর্তী সময়ে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিযোদ্ধারা এখানে জড়ো হতে থাকেন। বিভিন্ন এলাকা থেকে উদ্ধারকৃত অস্ত্রসামগ্রী, মাইন, মর্টার শেল, গ্রেনেড, গোলাবারুদ এখানে বাংকারে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু বিজয় অর্জনের মাত্র ২১ দিন পর ৬ জানুয়ারি সন্ধ্যার কিছু সময় আগে হঠাৎ ট্রানজিট ক্যাম্পে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়। মুহূর্তে অগুন ও কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয় আকাশ।

ওই ক্যাম্পে অবস্থানকারী ও প্রত্যক্ষদর্শী বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল হক, ফরহাদ আহমেদসহ কয়েকজন জানান, ৬ জানুয়ারি উদ্ধার করা কিছু অস্ত্র, মাইন ও গোলাবারুদ ট্রাক থেকে বাংকারে নামিয়ে রাখছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। এই সময় অসাবধানতাবশত মাইন বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।

মুক্তিযোদ্ধারা জানান, বিস্ফোরণ এতই শক্তিশালী ছিল যে স্কুলের আশপাশের বাড়িঘর ভেঙে পড়েছিল। স্কুলের সীমানাসহ আশপাশে পড়েছিল মানুষের ছিন্নভিন্ন দেহ। ঘটনাস্থলে মাটি সরে গিয়ে ২০-২৫ ফুট গভীর পুকুরে পরিণত হয়েছিল। ছয় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা সে সময় ক্যাম্পে উপস্থিত ছিলেন বলে তাঁদের ভাষ্য। যাঁদের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজন জীবিত ছিলেন। মর্মান্তিক সেই দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের স্কুল প্রাঙ্গণে ১২০ জনের এবং চেহেলগাজী সমাধিস্থলে ১৭৭ জনের নামফলক নির্মিত হয়। ১৯৮৮ সালে দিনাজপুরের কয়েকটি সংগঠন প্রথম শোকসভা করে। ওই বছর থেকে দিনাজপুরবাসী ৬ জানুয়ারি দিনটি মাইন বিস্ফোরণ ট্র্যাজেডি দিবস পালন করে আসছেন।