ময়মনসিংহের ভালুকায় সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বারবার আগুনের কারণ কী

ময়মনসিংহের ভালুকায় সংরক্ষিত বনাঞ্চলে অগ্নিকাণ্ডে প্রায় তিন একর বনভূমি পুড়ে গেছে। মঙ্গলবার সকালেছবি: প্রথম আলো

ময়মনসিংহের ভালুকায় সংরক্ষিত বনাঞ্চলে অগ্নিকাণ্ডে প্রায় তিন একর বনভূমি পুড়ে গেছে। পাঁচ দিনের ব্যবধানে গতকাল সোমবার দ্বিতীয়বারের মতো বনের বিভিন্ন অংশে আগুন লাগে।

ভালুকা-সখীপুর সড়কের ডাকাতিয়া ইউনিয়নের উথুরা রেঞ্জের আঙ্গারগারা বিটের অধীন চানপুর এলাকায় লাগা আগুনে বনাঞ্চলের গজারি ও সেগুনগাছের সুরক্ষায় লাগানো কাঁটাযুক্ত বেতবাগান পুড়ে গেছে। এতে হুমকিতে পড়েছে প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য।

আজ মঙ্গলবার সকালে সংরক্ষিত বনাঞ্চলে যেতেই নাকে ভেসে আসে পোড়া গন্ধ। গজারি-সেগুনগাছের সুরক্ষা দিতে বন বিভাগের লাগানো বেতবাগান পোড়ানোর পাশাপাশি বনের ভেতরের বাঁশবাগান পুড়েছে। আগুনে পুড়ে লতাগুল্ম ও ছোট ছোট গাছগুলোর বিবর্ণ অবস্থা। বন ঘুরে বিভিন্ন ছোট-বড় গাছের গোড়া কাটা দেখা যায়।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাঝেমধ্যে বনের গাছ চুরি হয়। গাছ চুরির জন্য বনে আগুন লাগানো হতে পারে। এর বাইরে পথচারীদের বিড়ি-সিগারেটের আগুন থেকেও বনের শুকনা পাতায় আগুন লাগতে পারে।

পোড়া বনে বেত কুড়াচ্ছিলেন নূরজাহান বেগম। তিনি বলেন, বন পুড়লে সরকারের ক্ষতি; কিন্তু যারা গাছ কাটে, তাঁদের জন্য লাভ। বনটি একসময় অনেক বড় থাকলেও দিন দিন ছোট হয়ে যাচ্ছে। আগে গাছপালার কারণে বনে ঢোকা না গেলেও এখন বনের ভেতর সবই দেখা যায়। তিনি বলেন, ‘এখান থাইকা মানুষ গাছ কাইটা কাইটা বেচে।’

আরও পড়ুন

পুড়ে যাওয়া বনের ভেতরের সড়কে কথা হয় ভ্যানচালক এলিম উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, মানুষ অহেতুক বেতগাছগুলো পুড়িয়ে দেয়। যারা পুড়িয়ে দিয়েছে, তাঁদের জন্য ভালো; কিন্তু বনের ক্ষতি তো আমাদের ক্ষতি। বেতবাগান পোড়ানো ঠিক হয়নি।

তবে বনে উদ্দেশ্যমূলকভাবে আগুন লেগেছে বলে মনে করেন না ময়মনসিংহ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আ ন ম আবদুল ওয়াদুদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কারও দুষ্টুমির কারণে বা অসতর্কতার কারণে আগুন লেগে থাকতে পারে। বন থেকে গাছ কেটে নেওয়ার পরিবেশ নেই।’ বনে গাছের গোড়া কাটার বিষয়ে জানালে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলব।’

বন পুড়লে সরকারের ক্ষতি; কিন্তু যারা গাছ কাটে, তাঁদের জন্য লাভ। মঙ্গলবার বন ঘুরে বিভিন্ন ছোট-বড় গাছের গোড়া কাটা দেখা যায়
ছবি: প্রথম আলো

আজ সকালে বন বিভাগের প্রতিনিধিদল বন ঘুরে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র দেখেন। এ সময় পুড়ে যাওয়া বনের ভেতরে দাঁড়িয়ে কথা হয় আংগারগারা বিটের তিনজন বনকর্মীর সঙ্গে। তিনি বলেন, বনে বেতবাগান করার উদ্দেশ্য—যাতে কেউ গজারিগাছ কেটে নিতে না পারেন। বেতবাগান পোড়ায় গাছ কাটা হতে পারে কি না, জানতে চাইলে তাঁরা বলেন, এমন সম্ভাবনা কম। বনের আশপাশে মানুষের বসতি কম। বন দখলের প্রবণতাও এখানে নেই। আগুনে বনের জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হয়েছে। বনে যেসব প্রাণী থাকত, তাঁদের আবাস নষ্ট হয়েছে। বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত এ পরিস্থিতি ঠিক হবে না।

বনকর্মীরা জানান, বনের আশপাশে কোনো শিল্পকারখানা ও বাড়িঘর নেই। প্রাকৃতিক এই বনের ভেতরে মাঝেমধ্যে নেশাজাতীয় ড্যান্ডি গামের উপকরণ পাওয়া যায়। নেশা করতে এসে কেউ আগুন লাগাতে পারে বলে তাঁরা ধারণা করছেন। আগুন লাগার ঘটনাগুলো সন্ধ্যার দিকেই ঘটে।

বনের নিরাপত্তাকর্মী ইজহারুল ইসলাম বলেন, বনে আগুন লাগলে নেভানোর জন্য পানি পাওয়া যায় না। পাতাযুক্ত ডাল দিয়ে আগুন নেভাতে হয়। এর বাইরে ফায়ার লাইন (শুকনা পাতার আস্তরণ সরিয়ে নালা নির্মাণ) কাটা হয়। পানি না থাকায় বনে আগুন নেভানো বেশ কষ্টসাধ্য।

গতকাল বিকেল চারটার দিকে এক দফা আগুন লাগলে তা নেভানো হয়। পরে বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে দ্বিতীয় দফা আগুন লাগে। বনকর্মীরা নিজেরা আগুন নেভানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার পর ফায়ার সার্ভিস গিয়ে রাত সোয়া নয়টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এর আগে গত বৃহস্পতিবার রাত ১১টার দিকে বনে আগুন লাগে। পাঁচ দিনের ব্যবধানে আগুনে প্রায় তিন একর বনভূমি পুড়ে যায়।

ভালুকা ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা আতিকুর রহমান বলেন, বনে আগুন লাগলে ‘স্টারভেশন’ পদ্ধতিতে আগুন নির্বাপণ করতে হয়েছে। নেভানোর জন্য পানি পাওয়া দুষ্কর ছিল।

ভালুকায় আগুনে পুড়ে যাওয়া বন ঘুরে ক্ষয়ক্ষতি দেখছেন বন বিভাগের কর্মীরা। মঙ্গলবার সকালে
ছবি: প্রথম আলো

আঙ্গারগারা বন বিটের অধীন ৫ হাজার ৬৭৯ একর বনভূমি আছে। এর মধ্যে অধিকাংশ বনভূমি জবরদখল হয়েছে। আঙ্গারগারা বিট কর্মকর্তা মো. মাজহারুল ইসলাম বলেন, দুই দফা আগুনে সবচেয়ে বড় গজারি-সেগুন বাগানের বেতবাগান, বাঁশবাগান ও নিচের পাতা পুড়ে গেছে। দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ায় ও বেতবাগানের কারণে তাঁরা ভেতরে ঢুকতে পারেননি। পথচারীদের কেউ আগুন লাগিয়ে দিতে পারে। এ বিষয়ে আজ থানায় জিডি করা হবে। একই সঙ্গে আগুন লাগানোর ঘটনায় কাউকে শনাক্ত করতে পারলে নিয়মিত মামলা করা হবে।

মাজহারুল ইসলাম বলেন, বন দখলের কোনো পরিস্থিতি নেই। কারও অসৎ উদ্দেশ্য ছিল বলেও মনে হচ্ছে না। শুকনা মৌসুমে প্রচুর পাতার কারণে বিভিন্ন বনে প্রায়ই আগুন লাগে। বনের এই অংশে এটাই প্রথম আগুনের ঘটনা। আগুনে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে তাঁরা কাজ করছেন। বনে বড় গাছের কোনো ক্ষতি না হলেও বেতবাগানের ক্ষতি হয়েছে। গোড়া কাটা গাছগুলো মরা ছিল। তাঁদের অগোচরে সেগুলো কাটা হয়। বনে আগুন দিয়ে গজারিগাছ কেটে নেওয়ার আশঙ্কা নেই। এর পরও টহল জোরদার করা হয়েছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের ভালুকা উপজেলার সদস্যসচিব কামরুল হাসান বলেন, বনে আগুন এমনিতেই লাগে না। আগুন লাগানো হয়। বনে আগুন দেওয়া হয় মূলত দুটি কারণে। প্রথমত গাছ কেটে নেওয়া এবং দ্বিতীয়ত বনের জমি দখল করা। বনে আগুন লাগানোর সঙ্গে যারা জড়িত, তাঁদের আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি বনের সুরক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।