রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এক যুগ পর প্রকাশ্যে ছাত্রশিবির, যা বলছে ছাত্রসংগঠনগুলো

প্রায় এক যুগ পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ইসলামী ছাত্রশিবির প্রকাশ্যে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোডেছবি: প্রথম আলো

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় এক যুগ ধরে ইসলামী ছাত্রশিবির প্রকাশ্যে দলীয় কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেনি। গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রায় ছয় মাস পর গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ক্যাম্পাসে দলীয় ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে সংগঠনটি। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোরআন পোড়ানোর ঘটনায় তদন্তের দৃশ্যমান অগ্রগতি না হওয়ার প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে তারা প্রকাশ্যে কর্মসূচি পালন করেছে। দীর্ঘদিন পর ছাত্রশিবিরের দলীয় ব্যানারে আত্মপ্রকাশ করাকে কেন্দ্র করে ক্যাম্পাসে সক্রিয় ছাত্রসংগঠনগুলো প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিতে ছাত্রশিবির সক্রিয় হওয়ার পর ক্যাম্পাসের ক্রিয়াশীল ছয়টি ছাত্রসংগঠনের সাতজন নেতার সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা বলেন, গোপনে রাজনীতি করার চেয়ে প্রকাশ্যে রাজনীতি করাই শ্রেয়। শিবির এখনো পুরোপুরি প্রকাশ্যে আসেনি। ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের ছয় মাস পার হয়েছে। এমন সময়ে লুকিয়ে রাজনীতি করা কৌশল হলে সেই কৌশলের আড়ালে নীল নকশা থাকতে পারে। কোরআন পোড়ানোর ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করতে না পারলে ক্যাম্পাসে বিভাজন ও ট্যাগিংয়ের রাজনীতি শুরু হবে।

ছাত্রশিবির ধর্ম চর্চা করছে নাকি রাজনীতি করছে, বিষয়টি এখনো পরিষ্কার নয় বলে মন্তব্য করেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মাহমুদুল হাসান। তিনি বলেন, ‘ক্যাম্পাসে এই মুহূর্তে রাজনীতি করার মতো সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় থাকার পরও রাতের আঁধারে মিছিল করা খুব বেশি ইতিবাচক নয়। জুলাই বিপ্লবের পর আমরা আশা করেছিলাম, দেশে ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে একটা নতুন রাজনৈতিক ধারা সূচিত হবে। ছাত্রসংগঠন হিসেবে ছাত্রশিবির কি এখনো ধর্ম নিয়েই রাজনীতি করার চেষ্টা করছে, নাকি জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের চেতনা নিয়ে রাজনীতি করছে, বিষয়টি আগে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে পরিষ্কার করতে হবে। তারা রাতের আঁধারে যেমন মিছিল করছে, তেমনি রাতের আঁধারের মতোই তাদের কমিটিকে লুকিয়ে রাখছে। তারা প্রকাশ্যে এসে রাজনীতি করুক, আমরা অবশ্যই সাধুবাদ জানাব। কিন্তু তারা পূর্ণাঙ্গ কমিটি প্রকাশ না করে ভিন্ন ব্যানারে, ভিন্ন সংগঠনে যুক্ত থেকে রাজনীতি করছে। বিপ্লবের ছয় মাস পরও এটি যদি তাদের কৌশল হয়, সেই কৌশল কিন্তু বেশি গোপন থাকলে আবার নীল নকশায় পরিণত হবে।’

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ছয় মাস পরও ছাত্রশিবির কেন গোপনে রাজনীতি করছে, সেটির ব্যাখ্যা সংগঠনটির নেতারাই দিতে পারবেন বলে মনে করেন শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক সুলতান আহমেদ। তিনি বলেন, ‘তারা অতীতে বিভিন্ন সংগঠনে অনুপ্রবেশ করেছিল, যা রাজনীতিতে সমালোচনার সৃষ্টি করেছে। তারা দীর্ঘদিন পর প্রকাশ্যে এসে মিছিল করেছে, এ জন্য তাদের স্বাগত জানাচ্ছি। তবে রাতের আঁধারে মিছিল না করে দিনের বেলা করলে সেটি আরও ভালো হতো।’ শিক্ষার্থীবান্ধব রাজনীতির পরিবেশ বজায় রাখতে এবং অরাজক পরিস্থিতি যেন ফিরে না আসে, সে জন্য সবাইকে সজাগ থাকতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয় শাখা নাগরিক ছাত্র ঐক্যের সদ্য সাবেক সভাপতি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক মেহেদী হাসান। তিনি বলেন, পবিত্র কোরআন পোড়ানোর ঘটনায় শিবির প্রকাশ্যে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে এটির সুষ্ঠু তদন্ত করতে হবে। এটি করতে না পারলে ক্যাম্পাসে বিভাজন ও ট্যাগিংয়ের রাজনীতি শুরু হবে। চলমান রাজনীতির যে বন্দোবস্ত এবং একে অপরের প্রতি যে ঐক্য, সেটি বিনষ্ট হবে। এই বিভাজন আস্তে আস্তে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে।

গণতান্ত্রিক শিক্ষাঙ্গনের জন্য ছাত্রশিবিরের আত্মপ্রকাশ উদ্বেগের বিষয় বলে মন্তব্য করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র গণমঞ্চের আহ্বায়ক নাসিম সরকার। তিনি বলেন, ‘৭১-এর গণহত্যার সঙ্গে সংযুক্তিসহ আশি-নব্বইয়ের দশকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহিংস কর্মকাণ্ডের কারণে ছাত্রদের প্রতিরোধের মুখে নানাভাবে ছাত্রশিবির নিষিদ্ধ হয়। আমরা মনে করি, নিজেদের ঐতিহাসিক ভূমিকাই গণতান্ত্রিক শিক্ষাঙ্গনের জন্য হুমকি হিসেবে স্বীকৃত ছাত্রশিবিরের আত্মপ্রকাশ উদ্বেগের বিষয়। তাদের ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ডই আরও পরিষ্কার করবে, ফ্যাসিবাদবিরোধী গণ-অভ্যুত্থানের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে ছাত্রশিবিরের উপস্থিতি আদৌ সংগতিপূর্ণ কি না।’

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রায় এক যুগ ধরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবির প্রকাশ্যে কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেনি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন বিনোদপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় তাদের কার্যক্রম চলমান ছিল। এ ছাড়া পবিত্র ঈদুল আজহায় আবাসিক হলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে গোপনে মাংস বিতরণ এবং ভর্তি পরীক্ষা চলাকালে দেয়াললিখন কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সেপ্টেম্বরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি ও সেক্রেটারির নাম প্রকাশ্যে আসে। এরপর ৭ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ও সেক্রেটারির পরিচয় প্রকাশ করে নতুন কমিটি গঠন করা হয়। এরপর দলীয় প্যাডে এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রচার ও মিডিয়া সম্পাদক নওসাজ্জামানের পরিচয় সামনে আসে। এরপর বৃহস্পতিবার বিক্ষোভ শেষে সমাবেশে বক্তব্য দেওয়ার মাধ্যমে কমিটিতে দপ্তর সম্পাদক মেহেদী হাসান, বায়তুলমাল সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম, মানবসম্পদ উন্নয়ন সম্পাদক সাহিদ ইমরান আছেন বলে পরিচয় প্রকাশিত হয়।

বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি শাকিল হোসেন বলেন, শিবিরের কোরআন বিতরণ কর্মসূচিতে গিয়ে ভিসি জানিয়েছেন যে পবিত্র কোরআন পোড়ানোর ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করা গেছে। এক সপ্তাহ সময় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যখন যথাসময়ে তদন্ত প্রতিবেদন দিচ্ছে না, তখন প্রশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন না করে ওনাকে কোরআন বিতরণ কর্মসূচিতে আমন্ত্রণ জানিয়ে শিবির রাজনৈতিক ফায়দা নিতে চায়, এটা স্পষ্ট। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিকভাবে আত্মপ্রকাশ জনমনে সন্দেহ তৈরি করে, ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করা হবে কি না! কোরআন পোড়ানোর ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিরা যদি শনাক্ত হন, তাহলে কেন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না? শিবিরের প্রকাশ্যে মিছিল করার সুযোগ করে দিতেই সম্ভবত যথাসময়ে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা হলো না।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি (একাংশ) রাকিব হোসেন বলেন, ‘যারা সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি করে, তারা ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থকে ব্যবহার করে রাজনীতি করে। ধর্ম লালনের জায়গা, যারা ধর্মকে হরণ করে রাজনীতি করে, তাদের আমরা প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী হিসেবে দেখি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্রনেতারা তাদের (ছাত্রশিবির) হাতে রক্তে রঞ্জিত হয়েছেন, বামপন্থী ছাত্রসংগঠনের নেতারা খুন হয়েছেন। তারা একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি এবং তারা এখন পর্যন্ত একাত্তরের স্বাধীনতাকে স্বীকার করে না। যারা একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী এবং ধর্মকে নিয়ে রাজনীতি করে, আমাদের অবস্থান সব সময় তাদের বিরুদ্ধে।’

ধর্মীয় বিষয়কে কেন্দ্র করে প্রকাশ্যে আসা ও অন্যান্য ছাত্রসংগঠনগুলোর প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে জানতে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি মুজাহিদ ফয়সালের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে যোগাযোগ করা হয়। তবে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।

আরও পড়ুন