সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল পেশাজীবীরা নানা সংকটে
খুলনার সর্বদক্ষিণের সুন্দরবন ঘেরা সমুদ্র উপকূলবর্তী উপজেলা কয়রা। উপজেলাটির মোট আয়তন সুন্দরবনসহ ১ হাজার ৭৭৫ দশমিক ৪১ বর্গকিলোমিটার এবং সুন্দরবন বাদে ২৬৩ দশমিক ১২ বর্গকিলোমিটার। কয়রায় বসবাসরত বেশির ভাগ মানুষ সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল পেশাজীবী। বর্তমানে তাঁরা নানা সংকটে তিন পার করছেন।
সুন্দরবন লাগোয়া গ্রামগুলোর পুরুষেরা সুন্দরবনে মাছ ধরা, গোলপাতা কাটা, কাঁকড়া ধরা ও মধু আহরণের কাজ করেন। আর নারী ও শিশুরা ব্যস্ত থাকেন কাঠ সংগ্রহ ও চিংড়ির পোনা ধরার কাজে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তাঁরা এই কাজ আঁকড়ে ধরে আছেন। কিন্তু বর্তমানে নানা সংকটে এসব বনজীবীদের জীবন ও জীবিকার ওপর প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে।
সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল পেশাজীবীরা বলছেন, সুন্দরবনের বিভিন্ন খাল ও নদীতে বর্তমানে মাছের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। বনের মধ্যে মৌচাকের দেখা মিলছে প্রত্যাশার চেয়েও অনেক কম। আর বন বিভাগ বনে প্রবেশ, গোলপাতা আহরণ ও নদী-খালে মাছ ধরার জায়গা সংকুচিত করে কড়াকড়ি শর্ত আরোপ করায় ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দিয়েছে। ফলে অনেক বনজীবী তাঁদের পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন।
কয়রা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে পাথরখালী গ্রাম। গ্রামটির ওপারে সুন্দরবন, এপারে লোকালয়। মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে শাকবাড়িয়া নদী। নদীর পাড়ে বসে মাছ ধরার জাল মেরামত করছিলেন বনজীবী জেলে মো. ময়জুদ্দিন মোড়ল। কথায় কথায় তিনি জানালেন, ‘বনের গাঙে আগে বড় বড় মাছ ছিল। এখন সে ধরনের মাছ নাই। মাছ থাকবে কি করে? চরপাটা, বেহেন্দি আর নেট জালে পড়ে ছোট ছোট পোনা সব মরে যায়। ফলে মাছ আর বড় হতি পারে না। সব মিলি বনজীবীরা এখন চরম খারাপ অবস্থায় আছে।’
আক্ষেপ করে ময়জুদ্দিন আরও বলেন, ‘৭০ বছরের বেশি বয়স হয়ে গেছে আমার। সেই ছোটকাল থেকে সুন্দরবনের নদী-খালে মাছ ধরতিছি। কিন্তু সংসারের অভাব-অনটন দূর করতি পারিলাম না। খায়ে-না খায়ে আমার জীবনডা কাইটে গেল। এখন ভাবতিছি ছাওয়ালগের কথা। আগের মতো সুন্দরবনে আর মাছও পাওয়া যায় না। আমার জীবন তো কাইটে গেল, ছাওয়ালগের কী হবি?’
শাকবাড়িয়া নদীর তীরে সুন্দরবন লাগোয়া গ্রাম গুড়িয়াবাড়ী, মঠবাড়ি, কাটকাটা, হরিহরপুর, গাতিরঘেরী ঘুরে এক সময়কার বনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁদের অনেকেই এখন বনের কাজ ছেড়ে মাটিকাটা, নদীভাঙন রোধে ব্লক বানানো, বালুর বস্তা নদীতে ফেলাসহ নানা কাজ করছেন।
পাথরখালী গ্রাম থেকে কাটকাটা গ্রামের দিকে যাওয়ার সময় পথে দেখা হয় কামরুল ইসলাম ও সিরাজুল ঢালীর সঙ্গে। তাঁরা বনের কাজ ছেড়ে পিঠে বড়ো এক ব্যাগ ঝুলিয়ে ইটভাটায় কাজ করতে যাচ্ছিলেন। কাটকাটা গ্রামের মফিজুল ইসলাম ও রবিউল ইসলাম জানালেন, সুন্দরবনের যেসব জায়গায় বেশি মধু পাওয়া যায়, সেসব জায়গা অভয়ারণ্য ঘোষণা করায় বন বিভাগ মধু আহরণে বাধা দেয়। এ কারণে অনেক খরচ ও কষ্ট করেও আশানুরূপ মধুর দেখা না পেয়ে লোকসান গুনতে হয়। তা ছাড়া আগের মতো জালে মাছ ধরা না পড়ায় এখন পরিবার–পরিজন নিয়ে কষ্টে চলছে সংসার।
হরিহরপুর গ্রামে গিয়ে দেখা হয় জেলে আবদুল্লাহ গাজীর সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘বন বিভাগের অনুমতি খরচ বাদেও প্রতি অমাবস্যা ও পূর্ণিমা গুনে জেলে নৌকাপ্রতি বন বিভাগকে ডিউটি খরচের নামে চাঁদা দিতে হয়। বাঘ-কুমিরের ভয়ডর উপেক্ষা করে টাকা আয় করি আমরা, আর বসে বসে ভাগ নেয় তারা।’
বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সুন্দরবনের খুলনা রেঞ্জের কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশনের আওতায় ৯৪৪টি বোট লাইসেন্স (বিএলসি) রয়েছে। এর মধ্যে প্রতি অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে গড়ে ৭০০ নৌকা নিয়ে প্রায় ২ হাজার জেলে মাছ ও কাঁকড়া ধরতে বনে যান। এ স্টেশনের আওতায় শাকবাড়িয়া, বজবজা, খাসিটানা ও আন্ধারমানিক নামে চারটি টহল ফাঁড়ি রয়েছে।
স্থানীয় জেলে আলমগীর হাওলাদার অভিযোগ করেন, সুন্দরবনের কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশন থেকে পাস নিয়ে প্রতিটি টহল ফাঁড়ি অতিক্রম করতে গেলে সেখানে ডিউটি খরচের নামে ২০০ টাকা করে ঘুষ দিতে হয়। তা না হলে জাল ও নৌকা আটকে রাখার হুমকি দেওয়া হয়।
জেলেদের ভাষ্য, এসব টহল ফাঁড়িতেই জেলেদের কাছ থেকে ডিউটি খরচের নামে অর্থ আদায় করা হচ্ছে। এ ছাড়া কাশিয়াবাদ স্টেশন থেকে পাস নেওয়ার সময় ১০০ এবং সমর্পণের সময় সরকারি রাজস্ব যা–ই থাক, ৭০০ টাকা করে দিতে হয়।
জানতে চাইলে কাশিয়াবাদ স্টেশন কর্মকর্তা নির্মল কুমার মণ্ডল বলেন, ‘টহল ফাঁড়ির স্টাফরা জেলেদের কাছ থেকে ডিউটি খরচ আদায় করেন, এটা সত্য কথা। বহু বছর আগে থেকেই এমনটি চলছে বলে শুনেছি। তবে আমি এখানে যোগদানের পর থেকে এসব বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছি। আশা করছি, অচিরেই সব অবৈধ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে।’
কয়রার সুন্দরবনসংলগ্ন মঠবাড়ি, পাথরখালী, নয়ানী গ্রামে গিয়ে চোখে পড়ে বনজীবীদের বিপন্ন বসতি। শাকবাড়িয়া নদীর ভাঙন এখানকার মানুষদের তাড়িয়ে ফিরছে। বহু মানুষ ঘূর্ণিঝড় আইলার পর থেকে বেড়িবাঁধের ভেতরে ও বাইরে আশ্রয় নিয়েছেন। বাঁধের দুই ধারে বনজীবীদের সারি সারি ছোট ঘর। পানির কষ্ট, খাবারের কষ্ট ও চিকিৎসার সংকট তাঁদের নিত্যসঙ্গী।
সুন্দরবনঘেঁষা ডাক্তারাবাদ বনরানী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আতিয়ার রহমানের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বললেন, বনজীবীদের গ্রামের অধিকাংশ ছেলেমেয়ে স্কুলে যায় না। যে বয়সে ওদের স্কুলে যাওয়ার কথা, সেই শিশুকাল থেকেই ওরা শুরু করে বনের প্রশিক্ষণ। কারণ, ওদের মা–বাবা, দাদা সবাই যে বনজীবী। এই পেশাই হয়তো হাতছানি দিয়ে ডাকছে ওদের। অসচেতন মা–বাবাকে বুঝিয়ে সন্তানদের স্কুলে আনতে বড্ড বেগ পেতে হয়।