কুমিল্লার ‘মুড়ি গ্রাম’, যেখানে ৬ দশক ধরে চলছে মুড়ি ভাজার ব্যবসা
কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামটির আলাদা পরিচয় আছে। কুমিল্লা-চাঁদপুর আঞ্চলিক মহাসড়ক লাগোয়া গ্রামটির বাসিন্দারা ছয় দশকের বেশি সময় ধরে হাতে ভাজা মুড়ি করে বিক্রি করেন। গ্রামটি তাই সবার কাছে ‘মুড়ির গ্রাম’ হিসেবে পরিচিত। পবিত্র রমজান ঘিরে গ্রামের ঘরে ঘরে মুড়ি ভাজার ধুম পড়েছে।
বৃহস্পতিবার সরেজমিনে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের অনেক আগ থেকেই লক্ষ্মীপুরে বাণিজ্যিকভাবে হাতে ভাজা মুড়ি বিক্রি শুরু হয়। দুই দশক আগেও গ্রামের বেশির ভাগ মানুষের আয়ের প্রধান উৎস ছিল হাতে ভাজা মুড়ি। তবে বর্তমানে সেই সংখ্যা কমে এসেছে। বর্তমানে ২৫ থেকে ৩০টি পরিবার এই পেশা ধরে রেখেছেন। গত কয়েক বছর ধরে চালের দাম বেশি থাকায় মুড়ি বিক্রিতে লাভ কমেছে, এ কারণে অনেকেই এ কাজ ছেড়ে দিয়েছিন।
লক্ষ্মীপুর গ্রামের দুর্গাচরণ পালের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, সারি সারি মাটির চুলার ওপর বসানো হয়েছে বড় বড় মাটির পাত্র। একজন চুলায় কাঠ-খড় দিয়ে আগুন দিচ্ছেন। আরেকজন আগে প্রস্তুত করা চাল এনে গরম পাত্রে ঢেলে দিচ্ছেন। পাশের অন্যজন নেড়ে দিচ্ছেন সেই চাল। পাঁচ থেকে সাত মিনিট নাড়ার পর সেই চাল ঢেলে দেওয়া হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা চুলায় থাকা আরেকটি পাত্রে। ওই পাত্রে থাকে গরম বালু। মুহূর্তেই সেই চাল থেকে হয়ে যায় মুড়ি। গরম গরম অবস্থায় এই মুড়ি বস্তায় ভরে নিয়ে যাওয়া হয় পাশের একটি গোডাউনে। সেখানে ঢেলে মুড়ি ভালোভাবে পরিষ্কার করা হয়। এরপর কয়েকজন আবার সেই মুড়ি বড় বড় বস্তায় ভরেন। প্রতি বস্তায় ৪৫ কেজি করে মুড়ি ভরা হয়। সেই মুড়ি নিয়ে যান পাইকারেরা।
দুর্গাচরণ পাল জানালেন, তিনিই গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুড়ি করেন। প্রতিবছরই পবিত্র রমজানের অন্তত ১৫ দিন আগ থেকে তাঁদের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। এই সময় প্রতিদিন রাত দুইটার দিকে শুরু হয় মুড়ি ভাজার কর্মযজ্ঞ, চলে পরের দিন বেলা সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত। বর্তমানে গ্রামের ২৫-৩০টি পরিবার মিলে প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ মণ মুড়ি ভাজে। কুমিল্লা ছাড়া এই মুড়ি যায় ফেনী, নোয়াখালী, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম ও ঢাকায়। গ্রামের উৎপাদনকারীরা প্রতি কেজি মুড়ি পাইকারের কাছে বিক্রি করেন ১১০ থেকে ১৫০ টাকায়। বর্তমানে সব কিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় সব খরচ বাদ দিয়ে প্রতি কেজিতে চার থেকে ছয় টাকা লাভ হয়। বাজারে হাতেভাজা ১ কেজি মুড়ি বিক্রি হয় ১৩০ থেকে ১৫০ টাকায়।
স্বপন পাল নামের আরেক মুড়ি উৎপাদনকারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের অনেক আগেই আমাদের দাদারা বাণিজ্যিকভাবে মুড়ি ভাজার কাজ করতেন। পরে করেছেন আমাদের বাবা–কাকারা। এখন করছি আমরা। তবে আমাদের সন্তানেরা মনে হয় না এই ধারা ধরে রাখবে। প্রতিবছরই মুড়ি উৎপাদনকারীর সংখ্যা কমছে।’ তিনি বলেন, তাঁরা বরিশাল থেকে মুড়ির ধান সংগ্রহ করেন। এরপর ধান থেকে মুড়ি তৈরির উপযুক্ত করে চাল করা হয়। প্রতি কেজি চাল ৮০ টাকা পড়ে।
হাতে ভাজা মুড়ি উৎপাদন ধরে রাখতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন শ্রীকৃষ্ণ পাল নামের এক উৎপাদনকারী। তিনি বলেন, সারা বছরই তাঁরা মুড়ি উৎপাদন করেন। তবে রমজান এলে ব্যস্ততা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। বর্তমানে প্রতিদিন ১০০ মণের বেশি মুড়ির চাহিদা আছে, কিন্তু পুরো গ্রাম মিলে জোগান দিতে পারে ৫০ থেকে ৬০ মণ।
শ্রীকৃষ্ণ পাল জানালেন, তাঁরা সাধারণত দুই ধরনের মুড়ি ভাজেন। এগুলো সবার কাছে গিগজ ও টাপি নামে পরিচিত। এই মুড়ি বাজারে পাওয়া মুড়ির চেয়ে একুট মোটা ও ভারি। দীর্ঘক্ষণ মুচমুচে থাকা এই মুড়ির স্বাদ বাজারের মুড়ির চেয়ে অনেক ভালো।
১০০ কেজি চালের মুড়ি ভাজতে পারলে জনপ্রতি ৩০০ টাকা করে ৯০০ টাকা পাওয়া যায় বলে জানিয়েছেন লক্ষ্মীপুর গ্রামের সাজেদা বেগম। তিনি বলেন, গত ১০ বছর ধরে তিনি শ্রমিক হিসেবে এই মুড়ি ভাজার কাজ করছেন। রাতে আবহাওয়া ঠান্ডা থাকায় মুড়ি ভাজার কাজ করতে তাঁদের সুবিধা হয়। প্রতি বছর রমজান মাস এলেই তাঁদের কাজের চাপে কয়েক গুণ বেড়ে যায়।
এ বিষয়ে বরুড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নু-এমং মারমা মং বলেন, লক্ষ্মীপুর গ্রামে উৎপাদিত হাতে ভাজা মুড়ি স্বাদে ও মানে অনন্য। প্রশাসন বিষয়টি সম্পর্কে জানে। এই শিল্প টিকিয়ে রাখতে উপজেলা প্রশাসন থেকে তাঁরা সহযোগিতা করার উদ্যোগ নেবেন।