রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র সাত মাসে সাতবার বন্ধ, দীর্ঘমেয়াদি অনিশ্চয়তা
আগামী সেপ্টেম্বরে কেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিটটি চালু হওয়ার কথা রয়েছে। তবে কয়লাসংকটে তা সম্ভব হবে কি না, শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
যান্ত্রিক ত্রুটিতে চলতি জুলাই মাসে প্রায় অর্ধেক সময় বন্ধ থাকা বাগেরহাটের রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ রয়েছে তৃতীয়বারের মতো। সর্বশেষ কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানি কয়লা না থাকায় গত শনিবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে সেখানকার উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালুর এক মাস না যেতেই চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি প্রথম দফায় কয়লার অভাবে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় কেন্দ্রটির। কয়লার অভাবে গত ২৪ এপ্রিল দ্বিতীয় দফায় উৎপাদন বন্ধ ছিল এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে। গত শনিবার রাতে কয়লার অভাবে তৃতীয় দফায় কেন্দ্রটি বন্ধ হওয়ার মাত্র ১০ দিন আগে যান্ত্রিক ত্রুটি সারিয়ে উৎপাদনে ফিরেছিল কেন্দ্রটি। বিদ্যুৎকেন্দ্র সূত্র বলছে, চালুর পর থেকে গেল সাত মাসে কয়লাসংকট ও যান্ত্রিক ত্রুটি মিলিয়ে সাতবার বন্ধ হলো কেন্দ্রটি। এর মধ্যে চারবার বন্ধ হয়েছে কারিগরি ত্রুটিতে, তিনবার কয়লার অভাবে।
সুন্দরবনের কাছের এই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জ্বালানি পুরোপুরি আমদানিনির্ভর। এখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়লা আসে ইন্দোনেশিয়া থেকে। মূলত ডলার-সংকটে ঋণপত্র খুলতে বিলম্বের জেরে কয়লাসংকটে পড়ে কেন্দ্রটি। তবে এরই মধ্যে রামপালের জন্য ৫৫ হাজার মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে একটি জাহাজ আসছে বলে বিদ্যুৎকেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে। এই কয়লা দিয়ে ৮ আগস্ট বিদ্যুৎকেন্দ্রটি আবার চালু করার আশা কর্তৃপক্ষের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির এক কর্মকর্তা বলেন, এর মধ্যেই আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা হয়েছে। কয়লার একটি জাহাজ দেশে আসছে। আগস্ট মাসের ৮ তারিখের দিকে রামপাল পুনরায় উৎপাদনে আসার সম্ভাবনা আছে। এ ছাড়া রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা নিয়ে আগস্ট মাসে আরও দুটি জাহাজ আসছে।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (বিআইএফপিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাঈদ একরাম উল্লাহ ও উপমহাব্যবস্থাপক আনোয়ারুল আজিমের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁদের পাওয়া যায়নি।
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা নিয়ে আসা জাহাজের স্থানীয় শিপিং এজেন্ট টগি শিপিং অ্যান্ড লজিস্টিকস লিমিটেডের সহকারী ব্যবস্থাপক (খুলনা) খন্দকার রিয়াজুল হক গতকাল সোমবার দুপুরে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ইন্দোনেশিয়া থেকে ৫৫ হাজার মেট্রিক টন কয়লা আসছে বাংলাদেশি পতাকাবাহী বসুন্ধরা ইমপ্রেস জাহাজে। কয়লার জাহাজটি ৩ আগস্ট চট্টগ্রাম বন্দরে আসবে। সেখান থেকে লাইটার জাহাজ হয়ে ৫ আগস্ট রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জেটিতে আসা শুরু করবে। মাদার ভেসেল মোংলায় আসবে ৬-৭ তারিখে। এর আগে ৫ তারিখ থেকে লাইটার জাহাজ আসা শুরু করবে।
জাহাজ চলাচল পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা মেরিন ট্রাফিকের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, ইন্দোনেশিয়ার মুয়ারা পান্তাই বন্দর থেকে কয়লা বোঝাই করে জাহাজটি গত ২৪ জুলাই রাতে চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্দেশে যাত্রা করে। ৪ আগস্ট বিকেলে জাহাজটি চট্টগ্রামে পৌঁছাবে। গতকাল দুপুরে জাহাজটি মালয়েশিয়ার মালাক্কা অঞ্চলসংলগ্ন সমুদ্র অতিক্রম করছিল।
খন্দকার রিয়াজুল হক বলেন, এই জাহাজের পর রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আগস্টেই আরও দুটি কয়লার জাহাজ আসবে। তবে ওই দুটি জাহাজ কবে আসবে, তার এখনো শিডিউল হয়নি বলে জানান তিনি। ইন্দোনেশিয়ার বন্দর দিয়ে দেশে আসতে একটি জাহাজের ১০ থেকে ১২ দিনের মতো সময় লাগে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির এক কর্মকর্তা বলেন, প্রথম ইউনিট পূর্ণ সক্ষমতায় চালু রাখতে যে পরিমাণ কয়লা প্রয়োজন হয়, তাতে ৫৫ হাজার মেট্রিক টন কয়লা দিয়ে বড়জোর ১০ দিন চালু রাখা যেতে পারে। যদি আরও দুই জাহাজ কয়লাও আসে, তা দিয়ে একটি ইউনিট বড় জোর এক মাস চালু রাখা যাবে।
ফলে রামপালে বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে অনিশ্চয়তা আশু কাটছে না। এই অনিশ্চয়তা দীর্ঘমেয়াদি হচ্ছে, যতক্ষণ না চাহিদার পুরো কয়লা আমদানির নিশ্চয়তা তৈরি হয়। এদিকে উৎপাদন বন্ধ থাকলেও চুক্তি অনুযায়ী পিডিবিকে কেন্দ্রের সক্ষমতা ব্যয় বা ক্যাপাসিটি চার্জ (কেন্দ্র ভাড়া) দিতে হবে।
ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ অর্থায়নে বাগেরহাটের রামপালে ৯১৫ একর জমিতে নির্মিত ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের কয়লানির্ভর কেন্দ্রটির কাগজপত্রে নাম মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্রজেক্ট। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নামে বহুল পরিচিত এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৬৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি ইউনিট। যার প্রথম ইউনিট বাণিজ্যিক উৎপাদনে যায় গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর। প্রথম ইউনিট পূর্ণমাত্রায় উৎপাদনে দৈনিক ৫ থেকে সাড়ে ৫ হাজার টন কয়লার প্রয়োজন হয়। আগামী সেপ্টেম্বরে কেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিটটি চালু হওয়ার কথা রয়েছে। তবে কয়লাসংকটে তা সম্ভব হবে কি না, শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
এর আগে ১৬ জুলাই রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র কারিগরি সমস্যার কারণে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পরে পাঁচ দিন বন্ধ থাকার পর ২১ জুলাই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পুনরায় উৎপাদনে আসে।
তার আগে গত ৩০ জুন রাত ৮টা ৪৬ মিনিটে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটে ইলেকট্রিক্যাল জেনারেটর ইউনিট প্রোটেকশনে ত্রুটি দেখা দেওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ ছিল। ১০ দিন বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ থাকার পর ১০ জুলাই সন্ধ্যা ৭টায় পুনরায় উৎপাদনে ফেরে। ইলেকট্রিক্যাল জেনারেটর ইউনিট প্রোটেকশনের ত্রুটি সারিয়ে ১০ জুলাই উৎপাদনে আসার ৪ দিনের মাথায় ১৩ জুলাই রাত ১০টা ২৯ মিনিটে কারিগরি সমস্যার কারণে আবারও উৎপাদন বন্ধ করে যায়। এর জেরে বিদ্যুৎ বন্ধ ছিল প্রায় ৯ ঘণ্টা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রথম ইউনিট বন্ধ হওয়ার আগে গত শনিবার সকাল ৭টার দিকে ৫০১ মেগাওয়াট পর্যন্ত সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। এরপর রাত ১২টার দিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন নেমে আসে ৩৮২ মেগাওয়াটে। পরে ধীরে ধীরে বিদ্যুতের লোড কমিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি রাত ৩টা ৩৮ মিনিটে একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হয়।