বিবিসির ১০০ অনুপ্রেরণাদায়ী নারী
মেয়েকে পড়তে দেয়নি, তাই রিকতা নিজেই গড়লেন প্রতিবন্ধীদের স্কুল
প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য একসময় স্কুল গড়লেন। জমি দিলেন রিকতার স্বামী। স্কুলটিতে শিক্ষার্থী ২৯৪ জন, শিক্ষক ২১ জন।
রিকতা আখতার বানু (৫২) পেশায় সিনিয়র স্টাফ নার্স। কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদের কোলঘেঁষা রমনা সরকারপাড়া গ্রামে তাঁর বাড়ি। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঠাঁই হয়নি তাঁর বাক্প্রতিবন্ধী মেয়ের। তাকে স্কুল থেকে ছাড়পত্র দিয়ে বিদায় করে দিলে জেদ চেপে বসে রিকতার। নিজেই একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। নিজের কর্মস্থল থেকে ফিরে রিকতা প্রতিবন্ধী শিশুদের মানসিক বিকাশে প্রতিদিন সময় দেন। তাঁর গড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখন ২৯৪ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে।
প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে এই সংগ্রামের কারণে বিবিসির ১০০ জন অনুপ্রেরণাদায়ী ও প্রভাবশালী নারীর তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন রিকতা। চলতি বছরের এই তালিকা গত মঙ্গলবার প্রকাশ করে বিবিসি।
রিকতা আখতারের মেয়ে তানভীন একজন বাক্প্রতিবন্ধী। ২০০৮ সালে তাকে স্থানীয় একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করান রিকতা। কিছুদিন পর শিক্ষকেরা বলেন, প্রতিবন্ধী শিশুকে তাঁরা পড়াবেন না। অনেক অনুরোধেও মেয়েকে সেখানে আর রাখতে পারেননি।
রিকতা আখতার বলেন, ‘সঙ্গী–সাথিদের স্কুলে যেতে দেখে মেয়ে কান্নাকাটি করত। নিজেই নিজের হাত-পা কামড়াত। একসময় মেয়ের সারা শরীর ক্ষতে ভরে গেল। সেই ব্যথায় মেয়ে রাতে ঘুমাতে পারত না। চিল্লাচিল্লি করে আমাদের ঘুম হারাম করে দিত। মেয়ের এমন কষ্ট দেখে একবার নিজেই আত্মহত্যার কথা ভেবেছিলাম। পরে মনে হলো, আমি নার্স। আমি আমার ও সমাজের সব প্রতিবন্ধী শিশুর সেবায় জীবন উৎসর্গ করব। এরপর এই স্কুল চালু করি।’
২০০৯ সালে রমনা সরকারপাড়া গ্রামে দোচালা টিনের একটি ঘরে ৬৩ জন প্রতিবন্ধী শিশুকে নিয়ে চালু হয় স্কুলটি। স্কুলের জন্য তাঁর স্বামী আবু তারিক আলম ২৬ শতক জমি দান করেন। কিন্তু শিক্ষক পাচ্ছিলেন না। প্রতিবন্ধী শিশুদের কেউ পড়াতে চাইতেন না। পরে তাঁর ব্যাকুলতা দেখে দেবর পড়াতে রাজি হন। আরও চারজন শিক্ষক নিয়ে বিদ্যালয় শুরু করেন। এখন সেই স্কুলে শিশু থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ২৯৪ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে।
কুড়িগ্রাম সদর থেকে চিলমারী নদীবন্দরে যেতে রমনা রেলস্টেশনের বিপরীতে কাঁচা সড়কের পাশে টিন দিয়ে ঘেরা স্থাপনায় একটি লোহার ফটক। তাতে বড় বড় করে লেখা ‘রিকতা আখতার বানু (লুৎফা) বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়’। ভেতরে ঢুকে ডান দিকে আধা পাকা ভবন পাওয়া গেল। সেটিতে পাশাপাশি নয়টি শ্রেণিকক্ষ। বিপরীত পাশে প্রধান শিক্ষকের কক্ষ ও শিক্ষক মিলনায়তন। শিশুদের বিশেষভাবে শেখানো ও ব্যায়াম করার জন্য টিনের একটি ঘর রয়েছে। তবে সেখানে তেমন কোনো সামগ্রী নেই।
গতকাল বুধবার দুপুরে সরেজমিনে দেখা গেল, বিদ্যালয়ের দক্ষিণ দিকের মাঠে শিক্ষার্থীদের দুপুরের খাবার রান্না হচ্ছে। রিকতা নিজেই রান্নার তদারকির দায়িত্ব পালন করছেন। বিদ্যালয়ের এক পাশে অভিভাবকদের বসার স্থান। অভিভাবকদের অনেকেই গতকাল বিদ্যালয়ে এসেছেন বিশ্বের প্রেরণাদায়ী ও প্রভাবশালী নারী রিকতা আখতারকে নতুন করে দেখতে।
এ সময় কথা হয় প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী মোস্তফার মা মোর্সেদা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার পরিবারের দুই মেয়ে ও এক ছেলে প্রতিবন্ধী। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে চেয়েছিলাম। স্যারেরা ভর্তি নেননি। পরে রিকতা আপার এই স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছি। সকালে ভ্যান গাড়ি গিয়ে বাসা থেকে শিশুকে নিয়ে আসে। আবার বিদ্যালয় ছুটির পর বাসায় পৌঁছে দেয়।’
রিকতা এখন স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি। ২০২০ সালে বিদ্যালয়টি এমপিওভুক্ত হয়। তার আগে মাত্র ছয়জন শিক্ষক ছিলেন। এখন শিক্ষক আছেন ২১ জন। একসময় স্কুল ফিডিং কার্যক্রমের আওতায় শিশুদের জন্য বিস্কুট দেওয়া হতো। এখন সেটি বন্ধ আছে। শিক্ষকেরা নিজেদের বেতনের কিছু টাকা চাঁদা হিসেবে দিয়ে প্রতিদিন শিশুদের টিফিনের ব্যবস্থা করেন। এ ছাড়া রিকতা মাসে কয়েকবার নিজের টাকায় শিশুদের দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করেন। তিনি ওই স্কুলের পরিচালনা পর্ষদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে আছেন।
মঙ্গলবার খবরটা শুনে রিকতার মধ্যে ভীষণ উত্তেজনা কাজ করেছিল বলে জানালেন। বললেন, ‘দুপুরে বিবিসি থেকে যখন আমাকে ফোন দিয়ে খবরটা জানায়, তখন আমি চিলমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একজন রোগীকে দেখছিলাম। খবর শুনে উত্তেজনায় আমার প্রেশার বেড়ে গিয়েছিল। পরে সহকর্মী এক নার্স আমাকে ধরে চেম্বারে নিয়ে যায়।’
বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক শাহীন শাহ প্রথম আলোকে বলেন, এই বিদ্যালয়ে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের শিশুরা পড়ালেখা করে। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন এসব শিশুর জন্য খেলার সামগ্রীসহ আরও কিছু সরঞ্জাম দরকার।
রিকতা আখতার বলেন, ‘এখনো আমাকে ও আমার বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সমাজের মানুষ অবহেলা করে। প্রতিটি সরকারি বিদ্যালয়ে পাঁচজন করে প্রতিবন্ধী শিশু ভর্তির কথা বলা আছে; কিন্তু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো প্রতিবন্ধী শিশুদের অবহেলার চোখে দেখে। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন এই শিশুদের প্রতি বৈষম্য দূর করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।’