কয়রার গ্রামে গ্রামে বাঁধ রক্ষায় মানুষের লড়াই
নদীতীরের বাঁধের ওপর কোথাও মাটির উঁচু দেয়াল, আবার কোথাও বালুভর্তি বস্তা সাজিয়ে উঁচু করে রাখা। বাঁধের ঢালে গাছের ডাল ফেলা হয়েছিল, যাতে ঢেউয়ের তোড়ে মাটি ধুয়ে না যায়। চারদিকে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে কাদামাটি। এমন দৃশ্য এখন খুলনার কয়রা উপজেলার প্রায় প্রতিটি গ্রামের বাঁধে। ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে উঁচু জোয়ার ঠেকাতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বেড়িবাঁধের ওপর দিনরাত স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে এভাবে দেয়াল তুলেছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে কয়রার সুন্দরবনসংলগ্ন নয়ানী গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, নয়ানি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সামনে থেকে প্রায় এক কিলোমিটার বাঁধের পিচ ঢালাই সড়কের ওপর মাটির দেয়াল দিয়ে উঁচু করা হয়েছে।
বাঁধের ওপর দেখা হয় গৌরাঙ্গ জোয়ার্দার, মনিশঙ্কর রায়, পলাশ কুমারসহ আরও অনেকের সঙ্গে। তাঁরা বলেন, গত রোববার রাত ৯টার দিকে ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে প্রবল দমকা হওয়ার সঙ্গে শুরু হয় টানা বৃষ্টি। জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায় কয়েক ফুট। ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে গ্রামের মানুষ ঝুড়ি-কোদাল নিয়ে চলে আসেন বাঁধে। গ্রামের নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ—যে যেভাবে পেরেছেন, বাঁধ উপচে লোকালয়ে লোনাপানি প্রবেশ ঠেকাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। হাতে হাত, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মাটি কেটে বাঁধের ওপর উঁচু দেয়াল তুলে জোয়ারের পানি ঠেকিয়ে দেন তাঁরা।
তবে শুধু নয়ানী গ্রামেই নয়, শাকবাড়িয়া, কপোতাক্ষ ও কয়রা নদীবেষ্টিত কয়রা উপজেলার মহেশ্বরীপুর, শিকারিবাড়ি, বাবুরাবাদ, মদিনাবাদ, সুতিয়া বাজার, পাতরখালী, কালীবাড়ি, শিঙেরচর, আংটিহারা, গোলখালী, জোড়শিং, চরামুখা গ্রামসহ প্রায় ২০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধজুড়ে মাটির দেয়াল তুলে জোয়ার ঠেকানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
মহেশ্বরীপুর এলাকার শাকবাড়িয়া নদী পাড়ের মসজিদের ইমাম আবদুস সবুর বলেন, ‘ঝড়ের রাতে নদীর জোয়ারের পানি বাঁধ ছাপিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলে আমি মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিই জোয়ারের পানি বাড়ছে, বাঁধ ছাপিয়ে এলাকা প্লাবিত হতে পারে। সবাই ঝুড়ি–কোদাল নিয়ে বেড়িবাঁধে এগিয়ে আসুন, তা না হলে বাঁধ টিকিয়ে রাখা যাবে না।’ এর কয়েক মিনিটের মধ্যেই এলাকার শতাধিক নারী-পুরুষ ঝড়বৃষ্টির মধ্যে বাঁধ এলাকায় ছুটে জোয়ারের পানি ঠেকিয়েছেন। এ কাজের জন্য কোনো পারিশ্রমিক নেই। কোনোভাবেই যেন পানি লোকালয়ে প্রবেশ করতে না পারে, সে জন্যই তাঁদের সম্মিলিত এই লড়াই।
কয়রার শিকারিবাড়ি গ্রামের নুরুল ইসলাম বলছিলেন, ‘ঝড়ের রাতে প্রশাসনের লোকজন আমাগে খালি আশ্রয়কেন্দ্রে যাবার জন্যি চাপাচাপি করে। আমরা যাইনি। যদি বাঁধ ভাঙে, তখন উপায় কী হবে আমাগে। এবার বাঁধ ভাঙলি এলাকায় থাকা আমাগের পক্ষে আর সম্ভব হবে না। তাই দিন–রাত বাঁধ উঁচু করে জোয়ার ঠেকাতে চেষ্টা করেছি।’
কয়রা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, কয়রায় ঘূর্ণিঝড় রিমালের ঝোড়ো বাতাসে বিধ্বস্ত বাড়ির সংখ্যা ৩০ হাজারের মতো। ২৮ হাজার ৩৯৬টি ঘরবাড়ি আংশিক ও ১ হাজার ৬২৬টি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গাছপালা। এই সংখ্যা গণনার বাইরে। এ ছাড়া অতিবৃষ্টিতে ও কয়েক জায়গায় লোনাপানিতে তলিয়ে গেছে প্রায় ৫০০ মাছের ঘের। কৃষির ক্ষতির পরিমাণ এখনো নিরূপণ করা শেষ হয়নি।
গতকাল বিকেলে কয়রার কপোতাক্ষ নদের পাড়ের দশালিয়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, নদের ভাঙা বাঁধ দিয়ে হু হু করে জোয়ারের পানি ঢুকছে পাশের চিংড়ি ঘেরে। সোমবার ভোরে নদের উঁচু জোয়ারে বাঁধের ১০০ মিটারের মতো দুটি জায়গা ভেঙে গিয়েছিল। সেখানে বাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে ছিলেন খুলনা পাউবোর উপসহকারী প্রকৌশলী সোলায়মান হোসেন। তিনি বলেন, ভাঙা বাঁধের পাশের চিংড়ি ঘেরের পর আরও একটি সড়ক আছে। ভাঙনে নদীর পানি সড়ক পেরিয়ে এখনো লোকালয়ে ঢোকেনি। ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধটি সংস্কারের কাজ দ্রুত শুরু হবে।
কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তারিক উজ জামান বলেন, ‘শঙ্কা থাকলেও কয়রায় সাধারণ মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এবার ঘূর্ণিঝড় রিমালে বাঁধের ক্ষতি কম হয়েছে। এলাকাবাসী স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে যেভাবে নদীর লোনাপানি ঠেকিয়ে দিল, তা অবিশ্বাস্য। পাউবোর ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের হিসাব-নিকাশ করছেন। এরপরই মেরামতের কাজ শুরু হবে।’
কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি বিদেশ রঞ্জন মৃধা বলেন, হাতে হাত ও কাঁধে কাঁধ রেখে ভাঙা বাঁধ মেরামত কিংবা জোয়ারের সময় নিচু বাঁধ মাটির দেয়াল তুলে উঁচু করার কাজ বহু আগে থেকেই এ এলাকার লোকজন করে আসছে। রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত যত বিরোধই থাকুক না কেন, এ কাজে কেউ পিছপা হন না। স্থায়ী মজবুত বাঁধ নির্মাণ ছাড়া কয়রাবাসীর মুক্তি নেই।