পাবনায় ছেলেকে নিয়ে ‘দখলের উৎসব’ আওয়ামী গডফাদার শামসুল হকের

দেড় যুগ আগে ছিলেন পাবনা জেলা জজ আদালতের আইনজীবী। পরিবারসহ থাকতেন একটি টিনশেড ঘরে। ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয়ী হন। পরে হন প্রতিমন্ত্রী। তারপরই ঘুরে যায় তাঁর ভাগ্যের চাকা। প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য (এমপি) পদের প্রভাব খাটিয়ে নিয়োগ–বাণিজ্য এবং নৌঘাট, হাটবাজার দখল শুরু করেন। এভাবে ১৬ বছরে তিনি ও তাঁর পরিবার শতকোটি টাকার মালিক বনে যায়। টিনশেড ঘরের স্থানে নির্মাণ করেছেন ডুপ্লেক্স ভবন। তাঁর বিরুদ্ধে সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন দুই শতাধিক বিঘা জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে।

নিয়োগ–বাণিজ্য ও জমি-ঘাট দখল করেই ক্ষান্ত হননি তিনি। নিজের দলের যেসব নেতা-কর্মী তাঁর বিরুদ্ধে ছিলেন, তাঁদের ওপর হামলা চালাতেন। মামলা দিয়ে করতেন হয়রানি। বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীদেরও মামলা দিয়ে হয়রানি করেছেন। এত সব অভিযোগ যাঁর বিরুদ্ধে, তিনি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও এমপি শামসুল হক (টুকু)। তিনি পাবনা-১ (বেড়া-সাঁথিয়া) আসন থেকে ২০০৮ সালে প্রথমবার এমপি নির্বাচিত হন। পরের তিনটি ‘বিতর্কিত’ নির্বাচনেও তিনি বিজয়ী হন। তাঁর বড় ছেলে আসিফ শামস (রঞ্জন) ও তাঁর সন্ত্রাসী বাহিনীর মাধ্যমে তিনি নৌঘাটসহ বিভিন্ন হাট দখল করে টোল ও খাজনা আদায় করতেন বলে অভিযোগ করেছেন এলাকাবাসী।

শামসুল হক কারাগারে এবং তাঁর ছেলে আসিফ শামস আত্মগোপনে থাকায় অভিযোগের বিষয়ে তাঁদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

গত ১৪ আগস্ট রাতে শামসুল হক ঢাকা থেকে কলেজছাত্র খালিদ হাসান সাইফুল্লাহ হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হন। ২০ দিন পুলিশি রিমান্ডে থাকার পর এখন তিনি জেলহাজতে। অন্যদিকে আসিফ শামস আত্মগোপনে রয়েছেন। কয়েক দিন আগে তিনি দেশের বাইরে পালিয়ে গেছেন বলে এলাকায় গুঞ্জন রয়েছে। সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে বিক্ষুব্ধ জনতা প্রথমেই শামসুল হকের বেড়া পৌরসভার বৃশালিখা মহল্লায় ডুপ্লেক্স ভবনে হামলা ও ভাঙচুর চালায়। ভবন থেকে সবকিছু লুটপাট করার পর আগুন ধরিয়ে দেয়। বিক্ষুব্ধ জনতা সীমানাপ্রাচীরের ইট পর্যন্ত খুলে নিয়ে গেছে। একই দিনে সাঁথিয়ায় অবস্থিত শামসুল হকের ছেলে আসিফ শামসের খামার থেকে শতাধিক গরু ও প্রায় ১৬টি পুকুরের মাছ লুট হয়। পরদিন বেড়া পৌর ভবনে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়।

শামসুল হক কারাগারে এবং তাঁর ছেলে আসিফ শামস আত্মগোপনে থাকায় অভিযোগের বিষয়ে তাঁদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

আরও পড়ুন

শামসুল হকের উত্থান

২০০৮ সালে পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শামসুল হক। এ সময় পাবনা-১ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাচ্ছেন সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী আবু সাইয়িদ—এমনটাই ধরে নিয়েছিলেন তাঁর সমর্থকেরা; কিন্তু তাঁকে বাদ দিয়ে শামসুল হককে মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে শামসুল হক জামায়াতের তৎকালীন আমির মতিউর রহমান নিজামীকে পরাজিত করে চমক সৃষ্টি করেন। তিনি প্রথমে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী, পরে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। সর্বশেষ ডেপুটি স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, বছর তিনেক আগে শামসুল হক তাঁর বড় ছেলে আসিফ শামসকে রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ঢাকা থেকে বেড়ায় নিয়ে আসেন। সে সময় তিনি ঢাকায় ভিওআইপির ব্যবসা করতেন। বেড়ায় এসে আসিফ বাবার সহায়তায় বেড়া পৌরসভার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে মেয়র হন। এরপর ‘বিতর্কিত’ একটি সম্মেলনের মাধ্যমে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।

নির্বাচনে শামসুল হক জামায়াতের তৎকালীন আমির মতিউর রহমান নিজামীকে পরাজিত করে চমক সৃষ্টি করেন। তিনি প্রথমে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী, পরে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। সর্বশেষ ডেপুটি স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

জমি দখলে অপ্রতিরোধ্য

বেড়ার মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ার পর আসিফ শামসের ক্ষমতা আরও বেড়ে যায়। গড়ে তোলেন সন্ত্রাসী বাহিনী। ওই বাহিনী বেড়া ও সাঁথিয়া উপজেলার হাটবাজার ও নৌঘাট দখল করে খাজনা ও টোল আদায় শুরু করে। যমুনা থেকে অবৈধভাবে বালু তুলে বিক্রি শুরু করে। শামসুল হকের পরিবারের সদস্যরা বেড়া পৌর এলাকার পায়না ও বাড়াদিয়া মহল্লার অন্তত ২১০ বিঘা কৃষিজমি দখল করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

শামসুল হক টুকুর এই বাড়ি একসময় ছিল বেড়া ও সাঁথিয়া উপজেলায় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। জনতার রোষে এখন এটি পরিত্যক্ত বাড়ি
ছবি: প্রথম আলো

গত ২২ সেপ্টেম্বর পায়না মহল্লায় গিয়ে কথা হয় ২০–২৫ ব্যক্তির সঙ্গে। তাঁরা জানান, ২০১২ সালের পর থেকে ওই এলাকায় পরিবারের সদস্যের নামে জমি কেনা শুরু করেন শামসুল হক। জমি কেনার সময় প্রচার করা হয়, সেখানে ‘সৌদিয়া অ্যাগ্রো সোলার পিভি পাওয়ার প্ল্যান্ট’ ও ‘লুৎফুন্নেছা ইউনিভার্সিটি অব অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি’ প্রতিষ্ঠা করা হবে। এভাবে দুই-তিন বছরের মধ্যে প্রায় ৯০ বিঘা জমি কেনেন তাঁরা। পাশাপাশি ২১০ বিঘা জমি দখল করেন। ২০১৮ সালের পর হঠাৎ তাঁরা ওই জমিতে বালু ফেলা শুরু করেন।

আরও পড়ুন

বেড়া পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর এনামুল হক শামীম বলেন, ‘বাবার প্রশ্রয়েই আসিফ শামস নানা অপকর্ম করেছেন। পায়না মহল্লায় আমার ৩৯ শতক জমি তিনি জোর করে দখল করেন। প্রতিবাদ করায় মামলা দিয়ে আমাকে দীর্ঘদিন এলাকাছাড়া করে রেখেছিলেন।’

দুই-তিন বছরের মধ্যে প্রায় ৯০ বিঘা জমি কেনেন তাঁরা। পাশাপাশি ২১০ বিঘা জমি দখল করেন। ২০১৮ সালের পর হঠাৎ তাঁরা ওই জমিতে বালু ফেলা শুরু করেন।

বাড়াদিয়া গ্রামের একরামুল হক বলেন, ‘আমার ৪৬ শতক জমিতে বছরে তিনটি ফসল আবাদ করতাম। দুই দিনের মধ্যে বালু ফালায়া আমার জমি দখল কইর‌্যা নিল। কান্নাকাটি কইর‌্যা বাধা দিব্যার গেছিল্যাম; কিন্তু আমাকে মারধর ও মামলার ভয় দেখানোয় পিছু হটি।’

পায়না মহল্লার অবসরপ্রাপ্ত কলেজশিক্ষক সানোয়ার হোসেন জানান, তাঁর আত্মীয়স্বজনের প্রায় ২৫ বিঘা জমি শামসুল হকের পরিবার বালু ফেলে দখল করে নিয়েছে। এর মধ্যে তাঁর নিজেরই পাঁচ বিঘা জমি রয়েছে। একই মহল্লার অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা কে এম আবদুল্লাহ বলেন, ‘আমার ৪২ শতক জমিতে খুব ভালো ফসল হতো। সেই জমি আজ টুকুর পরিবারের দখলে। আমাদের মহল্লা থেকে শুরু করে মোহনগঞ্জ পর্যন্ত শতাধিক কৃষকের অন্তত ২০০ বিঘা জমি তারা দখল করে রেখেছে। জমি রক্ষার জন্য আমরা মিটিং, মিছিল, প্রশাসনের কাছে আবেদন করাসহ অনেক কিছু করেছি; কিন্তু তাদের ক্ষমতার কাছে সব হারিয়ে গেছে।’

আরও পড়ুন

২০২১ সালের নভেম্বরে বেড়া পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হয়েই পৌর এলাকার বৃশালিখা মহল্লার নৌঘাট দখলে নেন শামসুল হকের ছেলে আসিফ শামস। ঘাটটি বিআইডব্লিউটিএর অধীন হলেও তিনি ওই সংস্থা থেকে ইজারা না নিয়ে সরকার পতনের আগপর্যন্ত নিজের লোকজন দিয়ে টোল আদায় করেছেন। যদিও বিআইডব্লিউটিএ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ঘাটের ইজারা দেওয়ার জন্য দরপত্র আহ্বান করে। মেসার্স বেড়া ট্রান্সপোর্টের মালিক নজরুল ইসলাম সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে ইজারা পান; কিন্তু জুনের শুরুতে তিনি ঘাটের নিয়ন্ত্রণ নিতে গেলে তাঁকে ঘাট থেকে তাড়িয়ে নিজের লোকজন দিয়ে টোল আদায় অব্যাহত রাখেন আসিফ শামস।

বেড়া পৌর ভবনের একটি কক্ষ। ভবনের প্রতিটি কক্ষই এভাবে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়
ছবি: প্রথম আলো

নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এই ঘাট দিয়ে মাসে গড়ে ২০ লাখ বস্তা সিমেন্ট নামানো হয়। প্রতি বস্তা দেড় টাকা হিসাবে মাসে ৩০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন আসিফ। আমি বৈধভাবে ইজারা নিয়েও ঘাটের দখল পাইনি। শামসুল হকের প্রশ্রয়ে আসিফ শামস আমাকে তাড়িয়ে ঘাট থেকে টাকা আদায় করেছেন। সরকার পতনের পরদিন আমি আমার ইজারা নেওয়া ঘাটটি বিআইডব্লিউটিএর মাধ্যমে ফেরত পাই।’

আমার ৪৬ শতক জমিতে বছরে তিনটি ফসল আবাদ করতাম। দুই দিনের মধ্যে বালু ফালায়া আমার জমি দখল কইর‌্যা নিল। কান্নাকাটি কইর‌্যা বাধা দিব্যার গেছিল্যাম; কিন্তু আমাকে মারধর ও মামলার ভয় দেখানোয় পিছু হটি
বাড়াদিয়া গ্রামের একরামুল হক

আসিফ শামস ২০২১ সালের নভেম্বরে বেড়া পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হয়েই উত্তরাঞ্চলের পশু ও সবজির সবচেয়ে বড় হাট বলে পরিচিত করমজা চতুরহাটের নিয়ন্ত্রণ নেন। তিনি প্রভাব খাটিয়ে নিজের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তির নামে বেড়া পৌরসভা থেকে হাটটি ইজারা নেন। এটি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১ কোটি ২৯ লাখ ও ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১ কোটি ৪৯ লাখ টাকায় ইজারা দেওয়া হয়েছিল।

হাটের সাবেক কয়েকজন ইজারাদার ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই হাট থেকে প্রতি মাসে ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা রাজস্ব আসে। অর্থাৎ বছরে গড়ে আট কোটি টাকা। এই টাকার পুরোটাই আসিফ শামস নিতেন। অর্থাৎ গত আড়াই বছরে তিনি এই হাট থেকে ইজারার ৩ কোটি ৪২ লাখ টাকা বাদ দিয়ে ১৬ কোটির বেশি টাকা আয় করেছেন।

আরও পড়ুন

আসিফ শামস সাঁথিয়ার সরকারি মৎস্য প্রজননকেন্দ্র দখল করে সেখানে গড়ে তোলেন সমন্বিত খামার। স্থানীয় মৎস্যজীবীদের সূত্রে জানা যায়, সরকারি মৎস্য প্রজননকেন্দ্রে ৩৭ বিঘা জমি ও ১০টি পুকুর রয়েছে। ২০০৬ সালে প্রজননকেন্দ্রটি মাছ চাষের জন্য সাঁথিয়া উপজেলা মৎস্য উন্নয়ন সমবায় সমিতিকে পাঁচ বছরের জন্য ইজারা দেওয়া হয়; কিন্তু ২০১১ সালে ইজারার সময় শেষ হলেও সমিতির পক্ষ থেকে তা আর নবায়ন করা হয়নি। একপর্যায়ে সেটি ২০১৫ সালের দিকে আসিফ শামস ইজারা ছাড়াই দখলে নিয়ে পুকুরে মাছ ছাড়ার পাশাপাশি গরুর খামার করেন। খামারে ছিল শতাধিক গরু। সরকার পতনের পর খামারের সব গরু ও পুকুরের মাছ লুট হয়ে যায়।

এ ছাড়া গত তিন বছরে যমুনা নদী থেকে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকার বালু তুলে শামসুল হক ও তাঁর পরিবারের লোকজন বিক্রি করে দিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বেড়া পোর্ট এলাকার হুরাসাগর নদের পাশের প্রায় তিন একর জায়গা দখল করে এই বালুর বড় একটি অংশ মজুত করে রাখা হয়েছিল।

এ বিষয়ে বেড়া পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও বালু ব্যবসায়ী এনামুল হক শামীম বলেন, যমুনা থেকে অবৈধভাবে বালু তুলে শামসুল হকের ছেলে তিন বছরে ১০০ কোটি টাকার বেশি আয় করেছেন।

শামসুল হকের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আবু সাইয়িদ অভিযোগ করেন, ২০০৮ সালে এমপি নির্বাচিত হয়েই সাঁথিয়া পৌর এলাকায় অবস্থিত তাঁর একটি বাড়ি দখল করে সেখানে আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয় বানিয়ে ১৬ বছর দখল করে রাখেন শামসুল হক। সরকার পতনের পর তিনি সেই বাড়ি ফিরে পেয়েছেন।

একপর্যায়ে সেটি ২০১৫ সালের দিকে আসিফ শামস ইজারা ছাড়াই দখলে নিয়ে পুকুরে মাছ ছাড়ার পাশাপাশি গরুর খামার করেন। খামারে ছিল শতাধিক গরু। সরকার পতনের পর খামারের সব গরু ও পুকুরের মাছ লুট হয়ে যায়।

প্রতিপক্ষের ওপর হামলা-নির্যাতন

২০০৮ সালের নির্বাচনের পর বেড়া ও সাঁথিয়ায় বিএনপি-জামায়াত একেবারেই কোণঠাসা হয়ে পড়ে। শামসুল হকের ১৬ বছরের সময়কালে তাঁর প্রতিপক্ষ বিএনপি বা জামায়াত ছিল না, ছিল আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশ। এই অংশের নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা ছিলেন আওয়ামী লীগের সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী আবু সাইয়িদের সমর্থক। ২০০৮ সালের পর ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে তিনটি সংসদ নির্বাচনে শামসুল হকের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আবু সাইয়িদ। ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ এসব নির্বাচনে শামসুল হক জয়ী হন। সাইয়িদ সমর্থকদের ওপর হামলা ও নির্যাতন সবচেয়ে বেশি হয়েছিল ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের পর। নির্বাচনে শামসুল হক জয়ী হওয়ার পরপরই মাঠে নামে তাঁর বড় ছেলে আসিফ শামসের বাহিনী। নির্বাচনে বিরোধিতা করায় তারা সাইয়িদের শতাধিক সমর্থককে পিটিয়ে আহত করে এবং দুই শতাধিক ব্যবসায়ীর দোকান বন্ধ করে দেয়। পরে অবশ্য মোটা অঙ্কের চাঁদা নিয়ে অনেক মালিককে দোকান খোলার সুযোগ দেওয়া হয়।

চাঁদা দিয়ে দোকান খোলার সুযোগ পাওয়া বেড়া বাসস্ট্যান্ড এলাকার ব্যবসায়ী ফজলুল হক বলেন, ‘নির্বাচনী প্রচারণার সময় শামসুল হকের পক্ষের লোকজন এসে মিছিলে অংশ নিতে বলেছিল। আমি মিছিলে যাইনি। এটাই ছিল আমার অপরাধ। নির্বাচনের পর তাঁর লোকজন এসে আমার দোকান তালা মেরে বন্ধ করে দেয়। শেষ পর্যন্ত ৪৮ দিন পর আমার দোকান খুলে দেওয়া হয়; কিন্তু সে জন্য আমাকে শামসুল হকের অনুসারী কয়েকজন নেতাকে ৭০ হাজার টাকার বেশি চাঁদা দিতে হয়।’

শামসুল হক বাহিনীর সদস্যরা হামলা চালিয়েছেন অভিযোগ করে আবু সাইয়িদ বলেন, ‘শামসুল হকের বিরুদ্ধে নির্বাচন করায় তিনি তাঁর সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে আমার ওপর কমপক্ষে ১৮ বার হামলা করিয়েছেন। আমার অগণিত নেতা-কর্মীর নামে বিস্ফোরকসহ বিভিন্ন ধরনের গায়েবি মামলা দিয়ে তাঁদের এলাকাছাড়া করে রেখেছিলেন। এই নির্বাচনী এলাকাকে তিনি ত্রাসের জনপদ বানিয়ে রেখেছিলেন। আমি তাঁর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেব।’

বেড়া উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. রইজউদ্দিন বলেন, ‘তিনি (শামসুল হক) আমাদের নেতা-কর্মীদের নামে কত যে গায়েবি মামলা দিয়েছেন, তার হিসাব বের করা মুশকিল। মামলার কারণে আমাদের নেতা-কর্মীর বেশির ভাগই বাড়িতে থাকতে পারেননি।’

শামসুল হক টুকুর ছেলে আসিফ শামসের অনেকগুলো বালুস্তূপের এটি একটি
ছবি: প্রথম আলো

বেড়া বালিকা পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন মো. নায়েব আলী। তাঁর কয়েকজন স্বজন আবু সাইয়িদের অনুসারী ছিলেন। ২০২১ সালের শুরুর দিকে আসিফ শামস বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। নায়েব আলীর অভিযোগ, সভাপতি হয়েই আসিফ শামস তাঁকে স্কুল থেকে তাড়াতে উঠেপড়ে লাগেন। ২০২১ সালের ১৯ জুলাই বিভিন্ন অভিযোগে তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়। গত ৩ ফেব্রুয়ারি বিকেলে শামসুল হকের লোকজন বাড়িতে ঢুকে তাঁকে লোহার পাইপ ও রড দিয়ে বেদম পিটুনি দেয়। এতে তাঁর বাঁ হাত ও পা ভেঙে যায়।

গত ৮ ফেব্রুয়ারি শামসুল হকের লোকজন বেড়া বাজারে আবু সাইয়িদের সমর্থক বেড়া পৌর এলাকার আমিনুল ইসলামকে রড ও হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর জখম করে। আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘মারাত্মক আহত হয়ে ঢাকার হাসপাতালে বেশ কিছুদিন চিকিৎসাধীন ছিলাম। শুধু নির্বাচনে তাঁর (শামসুল হক) পক্ষে না থাকায় আমার মতো শতাধিক ব্যক্তিকে এভাবে জখম করা হয়েছে।’

নির্বাচনী প্রচারণার সময় শামসুল হকের পক্ষের লোকজন এসে মিছিলে অংশ নিতে বলেছিল। আমি মিছিলে যাইনি। এটাই ছিল আমার অপরাধ। নির্বাচনের পর তাঁর লোকজন এসে আমার দোকান তালা মেরে বন্ধ করে দেয়। শেষ পর্যন্ত ৪৮ দিন পর আমার দোকান খুলে দেওয়া হয়; কিন্তু সে জন্য আমাকে শামসুল হকের অনুসারী কয়েকজন নেতাকে ৭০ হাজার টাকার বেশি চাঁদা দিতে হয়।
বেড়া বাসস্ট্যান্ড এলাকার ব্যবসায়ী ফজলুল হক

১৬ বছরে বেড়েছে সম্পদ

শামসুল হকের ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেড়া পৌরসভার বৃশালিখা মহল্লায় আড়াই কোটি টাকায় ২০১১ সালে একটি ডুপ্লেক্স ভবন নির্মাণ করেন শামসুল হক। এ ছাড়া বেড়া উপজেলার পায়না মহল্লায় প্রায় ৯০ বিঘা ও ঢালারচর ইউনিয়নে ৪০ বিঘা জমি তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে কেনা হয়। এসব জমির বর্তমান বাজারমূল্য সাড়ে ১০ কোটি টাকা। এ ছাড়া পায়না ও মোহনগঞ্জে তিনি ৭৫ কোটি টাকা মূল্যের ২১০ বিঘা জমি দখল করে নিয়েছেন।

১৬ বছরে অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে ১৮৪ গুণ

২০০৮ ও ২০২৪ সালে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামা বিশ্লেষণ করেও তাঁর স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ অস্বাভাবিকভাবে বাড়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। হলফনামার তথ্যানুযায়ী, ২০০৮ সালে শামসুল হকের বার্ষিক আয় ছিল মাত্র দুই লাখ পাঁচ হাজার টাকা। ২০২৪ সালে বার্ষিক আয় বেড়ে ১৩ গুণ, অর্থাৎ ২৬ লাখ ৮৪ হাজার ৫৭৮ টাকা হয়। আবার ২০০৮ সালে তাঁর অস্থাবর সম্পদের মূল্য ২ লাখ ৭৩ হাজার টাকা থাকলেও ২০২৪ সালে তা বেড়ে হয় ৫ কোটি ১ লাখ ৬৪ হাজার ৫৫৩ টাকা। অর্থাৎ ১৬ বছরে স্থাবর সম্পদ বেড়ে প্রায় ১৮৪ গুণ হয়। তবে তাঁর প্রকৃত সম্পদের তুলনায় হলফনামায় দেওয়া সম্পদের পরিমাণ অনেক কম বলে অভিযোগ করছেন তাঁর নির্বাচনী এলাকার মানুষ।