পাখির খোঁজে নগরে

পাখি সংরক্ষণে গণসচেতনতা বাড়াতে আগামী ৩ জানুয়ারি, শুক্রবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘পাখি মেলা ২০২৫’এর আয়োজন করা হয়েছে।

ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাচ্ছে কালোলেজ জৌরালি। সম্প্রতি রাজশাহী শহরের পদ্মা নদী সংলগ্ন টি বাঁধের পাশের একটি চরে ছবি: মোছাব্বের হোসেন
হাতে গোনা কিছু মানুষ আগে পাখি দেখতেন। এখন পাখি দেখা কেবল নয়, পাখির ছবি তোলা, সেই ছবি তোলাকে ঘিরে বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়ানোর কাজটাও সেরে নেন অনেকে। মূলত শীতের এই সময়ে পরিযায়ী পাখিরা আসে। এখনই পাখি দেখা, ছবি তোলা ও ঘুরে বেড়ানোর সময়।
ঢাকা
লাল মুনিয়া, গত মাসে রাজধানীর আফতাবনগরে
ছবি: প্রথম আলো

কোথায় পাখি দেখতে যায় লোকে: দিয়াবাড়ি, আফতাবনগর, কেরানীগঞ্জ, ধানমন্ডি লেক, রমনা পার্ক, বোটানিক্যাল গার্ডেন, বলধা গার্ডেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আশুলিয়া এবং তুরাগ নদের আশপাশের এলাকা।

কী কী পাখি দেখা যায়: শীতে সাধারণত পাতিসরালি, লাল মুনিয়া, চ্যাগা, বিভিন্ন ধরনের স্যান্ড পিপার দেখা যায়। অন্য সময় হুদহুদ, সুইচোরা, বাবুই, মুনিয়া, শালিক, ডাহুক, বিভিন্ন ধরনের মাছরাঙা, বুলবুলি, কোকিল, টিয়া, ঘুঘু, টুনটুনি, চিল, কাটুয়া চিল, বক, পানকৌড়ি, ফিঙে, ফটিকজল, মৌটুসি।

কারা পাখি দেখতে যান: শৌখিন আলোকচিত্রী, শিক্ষার্থী, পেশাদার আলোকচিত্রী, পাখিবিশেষজ্ঞ, গবেষকেরা এসব স্থানে পাখি দেখতে যান। এ ছাড়া সাধারণ মানুষের আনাগোনা তো আছেই।

খাবারের কী ব্যবস্থা: এসব স্থানে গেলে আশপাশে কিছু দোকান, ছোটখাটো রেস্তোরাঁ পাওয়া যাবে। সবচেয়ে ভালো হয় সঙ্গে করে শুকনা খাবার, খেজুর, বাদাম, কেক নিয়ে যাওয়া। এগুলো অনেকক্ষণ শক্তি জোগায়।

একা যাওয়া সমীচীন কি না: লোকসমাগম কম, এমন স্থানে একা না যাওয়াই ভালো। দামি মুঠোফোন বা ক্যামেরা ছিনতাই হতে পারে। দল বেঁধে ও আগে থেকে ওই এলাকার নিরাপত্তাব্যবস্থা সম্পর্কে জেনে তবেই যেতে হবে।

যাবেন যেভাবে: দিয়াবাড়ি উত্তরা থেকে কাছে। আর আফতাবনগর রামপুরা থেকে কাছে। এ ছাড়া বোটানিক্যাল গার্ডেন, বলধা গার্ডেনে রিকশায় যাওয়া যাবে। কেরানীগঞ্জে ইজিবাইকে করে যেতে পারেন। মোটরসাইকেলেও এসব স্থানে যাওয়া যাবে।

নিরাপত্তার জন্য সঙ্গে কী কী রাখা ভালো: ভোরে গেলে সঙ্গে টর্চলাইট, আরামদায়ক কেডস, বাইনোকুলার, ব্যাগে ফার্স্টএইড বক্স, সামান্য ব্যথানাশক ওষুধ রাখা ভালো।

পাখি দেখা নিয়ে পরামর্শ:

পাখিদের যেন ক্ষতি না হয়

পাখিপ্রেমী হতে হলে সবার আগে প্রয়োজন প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা। থাকতে হবে তাদের রক্ষা করার মানসিকতা। আর সর্বাগ্রে প্রয়োজন প্রকৃতির দারুণ এই সন্তানদের রং-রূপ আস্বাদন করার সক্ষমতা। পাখি দেখার সময় নিজের এবং পাখির উভয়ের নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রাখা প্রয়োজন। প্রথমত, যেখানে পাখি দেখতে যাবেন, সেখানে সাপ বা ওই জাতীয় কোনো বিষাক্ত সরিসৃপ থাকার সম্ভাবনা থাকলে অবশ্যই একটু উঁচু গলার বুট বা জুতা পরিধান করুন। অপরিচিত ঘাসবন ধরনের জায়গা হলে প্রতিটি পদক্ষেপ বুঝেশুনে ফেলুন। আপনি যদি নিজেকে পাখিপ্রামী দাবি করেন, তাহলে সবার আগে আপনাকে খেয়াল রাখতে হবে আপনার দ্বারা যাতে পাখিকুলের কোনো ক্ষতি না হয়।
আসকার ইবনে ফিরোজ , ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার

একেক পাখি দেখার একেক সময়

ক্যামেরা, ট্রাইপড, পোর্টেবল চেয়ার আর সবুজ পোশাক পাখির ছবি তোলায় সহায়ক। কোনো কোনো পাখি দিনের আলো সহ্য করে না, সেগুলো দেখতে হয় ভোরে। আর কিছু পাখি খাবার খেয়ে বিকেলে বসে থাকে। কোন পাখি কোন সময় দেখতে হয়, জেনে পাখি দেখতে বের হতে হবে।
আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ
এক জোড়া চখাচখি। ডিসেম্বরে রাজশাহীর পদ্মা নদীর চরে
ছবি: প্রথম আলো
রাজশাহী

কোথায় কোথায় পাখি দেখতে যায় লোকে: নৌকায় করে পাখি দেখতে যেতে হয় রাজশাহীতে। শহরে নেমে পদ্মার টি বাঁধের পাশেই বেশ কিছু চর আছে। সেগুলোর সবগুলোতেই পাখি আসে। এ ছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ও পাখি দেখার ভালো জায়গা।

কী কী পাখি দেখা যায়: শীতে পরিয়ায়ী পাখি দেখার জন্য রাজশাহীকে স্বর্গ বলা যেতে পারে। বিভিন্ন ধরনের মরচে ভূতিহাঁস, ফুলুরি হাঁস, পিয়াং হাঁস, রাঙা মানিকজোড়, কয়েক ধরনের পরিযায়ী রাজহাঁস, ছোট কালি প্যাঁচা, নীলকণ্ঠ, নানা ধরনের সুইচোরা, সরালি, ডুবুরি, মাছু মুরাল, গাংচোষা, বিভিন্ন ধরনের পানচিল, পাকরা উল্টোঠুঁটি, সাহেব বুলবুলি। এ ছাড়া শাহি চখাচখি, সাদা–বেগুনি বক, বাবু বাটান, গাংশালিক, টিয়া, বামুনে শালিক, মাছরাঙা অন্যতম।

কারা পাখি দেখতে যান: শীতে পাখি দেখা এমন অবস্থা হয় যে আগে থেকে নৌকা বুকিং না দিলে নৌকা পাওয়া কঠিন। সারা দিনে নৌকাপ্রতি ১ হাজার ৫০০ টাকা ভাড়া গুনতে হয়।

যেখানে যাবেন, খাবার কী ব্যবস্থা: টি বাঁধের পাশে সকালে গেলে কলাই রুটি খেতে পারেন। বিদ্যুৎ ও রহমানিয়া হোটেলের নামডাক আছে। সেখানে তিন বেলা সব খাবার পাওয়া যাবে। আছে বেশ কিছু নামী মিষ্টির দোকান। নবরূপ নামের একটি দোকানে পাওয়া যাবে প্রায় ৩০ ধরনের মিষ্টি। অন্য পিঠাও পাওয়া যাবে। পদ্মার তাজা মাছ দিয়ে খেতেও মন্দ লাগবে না।

একা যাওয়া সমীচীন কি না: রাজশাহীতে মাঝি পরিচিত হলে একা যেতে পারবেন। তবে দল বেঁধে গেলে নৌকা ভাড়া কমে যায়।

নিরাপত্তার জন্য সঙ্গে কী কী রাখা ভালো: লাইফ জ্যাকেট, টিউব, সাপ থেকে আত্মরক্ষার জন্য ছোট লাঠি। আর চরে নামলে অবশ্যই দেখে পা ফেলতে হবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পাতিসরালির ঝাঁক
ছবি: আসকার ইবনে ফিরোজ

কোথায় পাখি দেখতে যায় লোকে: পরিবহন চত্বর সংলগ্ন দুটি জলাশয় আছে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টারের ভেতরের হ্রদে পাখি আসে। বোটানিক্যাল গার্ডেনের সঙ্গে জয়াপাড়া লেকেও পাখি আসে।

কী কী পাখি দেখা যায়: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় পাতিসরালি। শামুকখোল, জলপিপি, ছোট জিরিয়া, ডাহুক, প্যাঁচা, কাঠশালিক, হলুদ বুক হরিয়াল, নানা ধরনের বক, পাতি মাছরাঙা, মেঘ হও মাছরাঙা। এসব পাখি বেশি দেখা যায় শীতকালে ও বিকেলবেলায়।

কারা পাখি দেখতে যান: পাখি–গবেষক, প্রকৃতিপ্রেমী, শিক্ষার্থী, সাধারণ মানুষও পাখি দেখতে যান।

খাবারের কী ব্যবস্থা: বটতলার খাবার এখানে প্রসিদ্ধ, বিভিন্ন ধরনের ভর্তার জুড়ি নেই। এ ছাড়া মাছ, মাংস, হাঁসের মাংস, ছোট মাছসহ নানা পদের পিঠা পাওয়া যাবে।

যাবেন যেভাবে: ঢাকার গাবতলী থেকে আরিচাগামী যেকোনো বাসে বা প্রাইভেট কারে করে যাওয়া যাবে।

চট্টগ্রাম
ইট-পাথরের শহর চট্টগ্রামে ধীরে ধীরে সবুজের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। ফলে শীতের সময় কিংবা পড়ন্ত বিকেলে পাখিদের কিচিরমিচির শুনতে স্থানীয় বাসিন্দাদের কিংবা পাখিপ্রেমীদের ভরসা শহর থেকে দূরে উপজেলাগুলোতে। তবে শহরের ভেতরেও কিছু স্থানে চাইলে বাইনোকুলার হাতে দেখা যায় দেশীয় পাখি।
লেজ নাচানি, চট্টগ্রাম নগরের বাকলিয়ায়
ছবি: নোবেল চাকমা

সিআরবি

কী কী পাখি দেখা যায়: নগরের সিআরবি শিরীষতলার আশপাশে শতবর্ষী পুরোনো গাছপালা রয়েছে। এসব গাছে কাঠঠোকরা, বসন্তবাউরি, টিয়া, কালো ফিঙে, ঘুঘুসহ আরও ২৭ প্রজাতির পাখি দেখা যায়। পরিযায়ী পাখির মধ্যে সুইচোরা, বাদামি কসাই, তাইগা চুটকিও আসে মাঝেমধ্যে। বিকেলে বিভিন্ন শিকারি পাখি যেমন চিল ও বাজপাখির আনাগোনা থাকে।

নীলটুনি
ছবি: সংগৃহীত

কারা বেশি যায়: সারা বছরই সিআরবিতে মানুষের আনাগোনা থাকে। তবে শীতের সকালে লোকসংখ্যা কম থাকায় পাখিদের আনাগোনা বেশি থাকে। পাখি দেখার লোক এখানে কম আসে। তবে ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি পাখি দেখার পরিকল্পনা থাকলে বাইনোকুলার হাতে আশপাশের পাহাড় ঘুরে দেখা যাবে।

ছোট পানকৌড়ি, চট্টগ্রামে
ছবি: সংগৃহীত

কোরিয়ান ইপিজেড

কী পাখি দেখা যায়: শীত এলেই অতিথি পাখির আগমনে মুখর হয়ে ওঠে কোরিয়ান ইপিজেড। আশপাশের পাহাড়ের গাছে দেশীয় পাখি ও অভ্যন্তরে থাকা ছোট ছোট হ্রদে পরিযায়ী পাখিরা ছুটে আসে।

কোথায় অবস্থিত: চট্টগ্রাম নগর থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরে আনোয়ারা উপজেলায় কোরিয়ান ইপিজেড অবস্থিত। চট্টগ্রাম নগরের শাহ আমানত সেতু এলাকা থেকে লোকাল বাস ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা করে কোরিয়ান ইপিজেডে যাওয়া যায়।

আর কোথায় পাখি দেখা যায়: চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদী, ফটিকছড়ি হাজারিখিল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, মেরিন একাডেমিসহ বিভিন্ন এলাকাতেও পরিযায়ী পাখি দেখা যায়।

কী কী পাখি আছে: কুন্তি হাঁস, জিরিয়া হাঁস, পাতারি হাঁস, রাজহাঁস, নীলশির, কানিবক, ধূসর বক, সাদা বক, জল ময়ূর, ডুবুরি, পানকৌড়ি, গঙ্গা কবুতর, জলপিপি, কাস্তেচরা, রাজসরালিসহ বিভিন্ন পাখি দেখা যায়।

খাবারদাবার ও সরঞ্জাম: চট্টগ্রাম নগর থেকে স্থানীয় পরিবহনে করে এসব জায়গায় যাওয়া যায়। খাবারের ব্যবস্থার জন্য আশপাশে রয়েছে হোটেল-রেস্তোরাঁ। নিরাপত্তার জন্য দল বেঁধে যাওয়া ভালো। একা গেলে জনসমাগম এলাকায় থাকা নিরাপদ। পাখির ছবি তুলতে চাইলে প্রয়োজনীয় ক্যামেরা, লেন্স সঙ্গে রাখবেন। শুধু দেখতে চাইলে ভালো মানের বাইনোকুলার সঙ্গে রাখবেন।

সিলেট
‌সিলেটের দ‌ক্ষিণ সুরমার বগলাজান হাও‌রে অ‌তি‌থি পা‌খি
ছবি: প্রথম আলো

কোথায় কোথায় পাখি দেখতে যায় লোকে: নগরের দক্ষিণ সুরমার রেলস্টেশন ও মোমিনখলা এলাকার বগলাজান হাওর, জৈন্তাপুর উপজেলার ডিবির হাওর, কোম্পানীগঞ্জের তেলিখাল রামাইল শাপলাবিল, গোয়াইনঘাটের রাতারগুল। এ ছাড়া সিলেটের খাদিম জাতীয় উদ্যান।

কী কী পাখি দেখা যায়: অতিথি পাখিদের মধ্যে পাতি সরালি হাঁস, শামুকখোল, জল ময়ূর ও মেটে মাথার টিটি। খাদিমজাতীয় উদ্যানে শালিক, ঘুঘু, টিয়া, ময়না, ঝুঁটি শালিক, দোয়েল, মাছরাঙা, কালিম, বসন্ত বাউরিসহ নানা জাতের পাখি।

বগলাজান হাও‌রে অ‌তি‌থি পা‌খি
ছবি: প্রথম আলো

কোন সময় পাখি দেখতে বেশি যায় লোকে: অক্টোবরের শেষের দিকে অতিথি পাখিগুলো হাওর এবং বিলে নামে। হাওর ও বিলগুলোতে শীতের সময়েই মানুষজন পাখি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে যান। বিশেষ করে নভেম্বরের শুরু থেকে মার্চ পর্যন্ত।

যেখানে যাবেন, সেখানে খাবারের কী ব্যবস্থা: সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের তেলিখাল এলাকায় কোনো রেস্তোরাঁ নেই। তবে পথে সালুটিকর বাজারে রেস্তোরাঁ পাওয়া যাবে। এ ছাড়া সিলেট বিমানবন্দর এলাকায় পাওয়া যাবে কয়েকটি রেস্তোরাঁ। রেস্তোরাঁগুলোতে দেশি মুরগি, হাঁস এবং গরুর মাংস ও মাছ রান্না করে থাকে। যার দাম ১২০ থেকে ২৫০ টাকা। রাতারগুলের রেস্তোরাঁগুলোতেও একই দামের মধ্যে খাওয়া সেরে নেওয়া যাবে।

দ‌ক্ষিণ সুরমার বগলাজান হাও‌রে অ‌তি‌থি পা‌খি
ছবি: প্রথম আলো

নিরাপত্তার জন্য: পাখি দেখতে যাওয়া এলাকাগুলো নিরিবিলি থাকে। সঙ্গে একটি বাঁশের ছোট লাঠি রাখা যেতে পারে। পরিযায়ী পাখিগুলো ডোবায় থাকায় ডোবার আশপাশে যেতে হবে, যাতে ডোবার মধ্যে পানিতে পড়ে না যান, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

পাখি দেখার কিছু গ্রুপ
  • তথ্য দিয়েছেন মোছাব্বের হোসেন, ঢাকা ও ফাহিম আল সামাদ, চট্টগ্রাম