খুলনা নগরের শান্তিধাম মোড়ের পঞ্চবীথি ক্রীড়া চক্র ক্লাব ‘দখল’ ও ‘দখলমুক্ত’ করার ইস্যুকে কেন্দ্র করে গণ অধিকার পরিষদ ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা এখন মুখোমুখি অবস্থানে। পাল্টাপাল্টি মামলাও করেছে দুই পক্ষ।
১৮ মার্চ রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘোষণা দিয়ে গণ অধিকার পরিষদের দখলে থাকা পঞ্চবীথি ক্রীড়া চক্র ক্লাব দখলমুক্ত করতে যান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা। এ সময় দুই দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও মারামারির ঘটনা ঘটে।
এর আগে গত ১৭ জানুয়ারি পঞ্চবীথি ক্রীড়া চক্র ক্লাব কার্যালয়ের তালা ভেঙে ভেতরে ঢোকেন গণ অধিকার পরিষদের নেতা-কর্মীরা। সেই দিনই পঞ্চবীথি ক্রীড়া চক্রের সাইনবোর্ড নামিয়ে সেখানে ‘গণ অধিকার পরিষদ, খুলনা মহানগর ও জেলা কার্যালয়’ লেখা ব্যানার টানিয়ে দেন তাঁরা। দখলের পর থেকে সেখানেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হতো।
দখল করা ভবনটি দখলমুক্ত করতে যান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা। অবশ্য বৈষম্যবিরোধীদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দখলমুক্ত করার অভিযান পরিচালনা করেছেন ‘ছাত্র-জনতা’। এর মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা থাকতে পারেন, তবে সেটি স্বতন্ত্রভাবে। আর গণ অধিকার পরিষদের পক্ষ থেকে সরাসরি অভিযুক্ত করা হয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে।
পঞ্চবীথি ক্রীড়া চক্র ক্লাবটির কার্যক্রম যে ভবনে পরিচালনা করা হতো, সেটি মূলত গণপূর্তের একটি দ্বিতল ভবন। ভবনের দ্বিতীয় তলায় ক্লাবের কার্যক্রম চলত। নিচতলায় ছিল আরও কিছু কার্যালয়। ২০১০ সালের দিকে গণপূর্ত বিভাগ থেকে নিজেদের নামে বরাদ্দ নিয়ে আসে পঞ্চবীথি ক্রীড়া চক্র। এরপর ১৪ বছর ধরে সেখানে ক্লাবের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিলেন পঞ্চবীথি ক্রীড়া চক্রের কর্মকর্তারা। ৫ আগস্টের গণ–অভ্যুত্থানের পর ক্লাবটির কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যায়। এরপর তলাবদ্ধ অবস্থায় ছিল সেটি।
গণ অধিকার পরিষদের নেতাদের অভিযোগ, ক্লাবের মধ্যে জুয়া, মদ ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হতো। এ কারণে তাঁরা সেখান থেকে ক্লাবটি উচ্ছেদ করেছেন। ওই ভবনে যেন কোনো অনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা না হয়, সে জন্য তাঁরা সেখানে অবস্থান করছিলেন। তা ছাড়া ভবনটি ইজারা পেতে গণপূর্ত অধিদপ্তরে আবেদন করেছেন তাঁরা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বলছেন, পঞ্চবীথি ক্রীড়া চক্র একটি ঐতিহ্যবাহী ক্লাব। খুলনার ক্রীড়াঙ্গনে ক্লাবটির বেশ ভূমিকা আছে। ক্লাবের দখলে থাকা ভবন হঠাৎ নিজেদের দখলে নেয় গণ অধিকার পরিষদ। এর মধ্য দিয়ে দলটি খুলনায় দখলের রাজনীতি শুরু করেছে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দখল হয়ে যাওয়া ভবন দখলমুক্ত করতে সাহস পায়নি। এ কারণে ছাত্র-জনতা সেটি দখলমুক্ত করে পুলিশের কাছে বুঝিয়ে দিয়েছেন।
১৮ মার্চ রাত ৯টার দিকে ভবন দখলমুক্ত করার সময় সেখান থেকে গণ অধিকার পরিষদের নেতা-কর্মীদের বের করে দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা। পুড়িয়ে দেওয়া হয় গণ অধিকার পরিষদের ব্যানার এবং ভাঙচুর করা হয় আসবাব। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনাও ঘটে। দুই পক্ষের অন্তত ২০ জন আহত হন।
ওই ঘটনায় পাল্টাপাল্টি মামলাও করা হয়েছে। ২১ মার্চ গণ অধিকার পরিষদের খুলনা মহানগরের সাধারণ সম্পাদক শেখ রাশেদুল ইসলাম বাদী হয়ে খুলনা সদর থানায় একটি মামলা করেন। মামলায় আসামি করা হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন খুলনা জেলা কমিটির সদস্যসচিব সাজিদুল ইসলাম, মহানগরের যুগ্ম সদস্যসচিব নাজমুল হোসেন, মহররম মাহীম, শেখ রাফসান জানি ও রুমি রহমানকে। অজ্ঞাত আসামি করা হয় ৫০-৬০ জনকে।
অন্যদিকে ওই সংঘর্ষের ঘটনায় মারধরের অভিযোগে সোমবার পাল্টা মামলা করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের খুলনা মহানগরের যুগ্ম আহ্বায়ক নাঈম হাওলাদার। ওই মামলায় গণ অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি নুরুল হক ও খুলনা মহানগরের সাধারণ সম্পাদক শেখ রাশিদুল ইসলামসহ চারজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে ২০ থেকে ২৫ জনকে। অন্য দুই আসামি হলেন যুব অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক মো. জনি ও তাইজুল ইসলাম। একই দিন টাকা ছিনতাইয়ের অভিযোগে আরও একটি মামলা করেন জেলা কমিটির সদস্য শেখ সাকিব আহমেদ। ওই মামলায় জনি ও রাশেদের সঙ্গে গণ অধিকার পরিষদের খুলনা মহানগরের সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজ শেখ ও হিরোনকে আসামি করা হয়।
এসব বিষয়ে গণ অধিকার পরিষদ খুলনা মহানগরের সাধারণ সম্পাদক শেখ রাশেদুল ইসলাম বলেন, ‘মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা দেওয়া হয়েছে। সেই মামলায় আবার আসামি করা হয়েছে কেন্দ্রীয় সভাপতিকে। ওই মামলার কোনো ভিত্তি নেই।’ পুলিশ কীভাবে সেই মামলা নিল, সে প্রশ্ন তোলেন তিনি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন খুলনা জেলা কমিটির সদস্যসচিব সাজিদুল ইসলামের ভাষ্য, ‘এটা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বা জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) বিষয় না। এখানে ছাত্র-জনতা দখলদারির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। এটা আমাদের জন্য গৌরবের যে মানুষ আজ প্রতিবাদ করা শিখে গেছে।’
প্রসঙ্গত, খুলনায় এনসিপির কোনো কমিটি নেই।
নতুন দুই দলের নেতা-কর্মীরা খুলনায় দখল, চাঁদাবাজি, মারামারিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাধারণ মানুষ। এ ছাড়া কয়েক দিন আগে গাজীপুরের শ্রীপুর পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. নুর আলমকে অপহরণ ও মুক্তিপণ দাবি করায় গ্রেপ্তার হয়েছেন জাতীয় নাগরিক কমিটি খুলনার এক নেতা।
বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ উজ জামান বলেন, জুলাই বিপ্লবের যে স্পিরিট সাধারণ মানুষের মধ্যে ছিল, তা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। গণ অধিকার পরিষদও তরুণদের রাজনৈতিক দল হিসেবে যে আস্থা অর্জন করার কথা ছিল, তা করতে পারেননি; বরং তাঁদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড সাধারণ মানুষকে বিব্রত করছে। সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করতে যে ধরনের কর্মকাণ্ড করা প্রয়োজন, তার কোনোটিই করছেন না ওই দুই রাজনৈতিক দলের নেতারা।