২১ বছর ধরে গাইবান্ধায় কর্মরত সেই প্রকৌশলী, ঘুষ নেওয়ার অভিযোগও আছে

গাইবান্ধা এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ছাবিউল ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত

২০০৫ সালের ২১ ডিসেম্বর সাঘাটা উপজেলা প্রকৌশলী হিসেবে গাইবান্ধা জেলায় এসেছিলেন মো. ছাবিউল ইসলাম। বর্তমানে তিনি গাইবান্ধা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) নির্বাহী প্রকৌশলী। এই দীর্ঘ ২১ বছর তিনি গাইবান্ধা জেলাতেই কর্মরত আছেন। মাঝখানে তাঁকে বরিশালে বদলি করা হলেও ২৩ দিনের মাথায় আবারও গাইবান্ধায় চলে আসেন।

গত বৃহস্পতিবার রাতে গাইবান্ধা থেকে রাজশাহী যাওয়ার পথে নাটোরের সিংড়া উপজেলায় এই প্রকৌশলীর গাড়ি তল্লাশি করে প্রায় ৩৭ লাখ টাকা জব্দ করেন যৌথ বাহিনীর সদস্যরা। গাইবান্ধা এলজিইডির ঠিকাদারেরা বলছেন, ছাবিউল ইসলাম দীর্ঘ সময় একই জেলায় থাকার কারণে ‘প্রভাবশালী’ হয়ে ওঠেন। ঠিকাদারেরা তাঁর কাছে একরকম জিম্মি হয়ে পড়েন। ঘুষ (পারসোনাল কমিশন-পিসি) ছাড়া ফাইল সই করেন না বলে অভিযোগ করেছেন ঠিকাদারেরা।

গাইবান্ধা এলজিইডি কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ছাবিউল ইসলামের গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলায়। বর্তমানে তিনি রাজশাহী নগরে বাড়ি করেছেন। সেখানেই বসবাস করেন। তিনি ২০০৫ সালের ২১ ডিসেম্বর উপজেলা প্রকৌশলী হিসেবে গাইবান্ধার সাঘাটায় যোগদান করেন। এখানে কর্মরত থাকেন ২০২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এই কর্মস্থলে দায়িত্ব পালন করেন টানা ১৪ বছর ১ মাস ২২ দিন। এরপর জ্যেষ্ঠ সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে ছাবিউল ইসলাম এলজিইডি গাইবান্ধা জেলা কার্যালয়ে যোগ দেন। এই পদে ২০২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২১ সালের বছরের ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১ বছর ৬ মাস ২৮ দিন দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তিনি সাঘাটা উপজেলায় (উপজেলা প্রকৌশলী) অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন।

নাটোরের সিংড়ায় গাড়ি তল্লাশির সময় গাইবান্ধার এলজিইডি নির্বাহী প্রকৌশলী ছাবিউল ইসলামের গাড়ি থেকে প্রায় ৩৭ লাখ টাকা উদ্ধার করে পুলিশ। বৃহস্পতিবার রাতে নাটোর-বগুড়া মহাসড়কের সদরের চলনবিল গেট এলাকায়
ছবি: সংগৃহীত

এলজিইডি কার্যালয় সূত্রে আরও জানা গেছে, ছাবিউল ইসলাম নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে ২০২১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর বরিশাল জেলায় যোগ দেন। সেখানে মাত্র ২৩ দিন দায়িত্ব পালন করেন। তদবির করে একই সালের ৬ অক্টোবর গাইবান্ধায় বদলি নেন। পরদিন ৭ অক্টোবর তিনি গাইবান্ধা এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে যোগদান করেন। একই বছরের ৮ নভেম্বর তিনি পূর্ববর্তী নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নেন। সাঘাটায় যোগদানের পর থেকে চলতি বছরের ১৩ মার্চ পর্যন্ত ঘুরে ফিরে ২০ বছর ৯ মাস ৮ দিন গাইবান্ধা জেলায় কর্মরত।

ঠিকাদার ও এলজিইডির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছাবিউল ইসলাম জাতীয় সংসদের সাবেক ডেপুটি স্পিকার ও গাইবান্ধা-৫ (সাঘাটা-ফুলছড়ি) আসনের সংসদ সদস্য প্রয়াত ফজলে রাব্বী মিয়ার ‘পালিত ছেলে’ বলে পরিচিত ছিলেন। তাঁর দাপটেই ছাবিউল ইসলাম দীর্ঘদিন গাইবান্ধায় থাকার সুযোগ পান। ২০২২ সালের ২২ জুলাই ফজলে রাব্বী মারা গেলেও তিনি আওয়ামী লীগের ছত্রচ্ছায়ায় থাকেন।

সরকারি চাকরিবিধি অনুযায়ী, একজন সরকারি কর্মকর্তা একই কর্মস্থলে টানা তিন বছরের বেশি থাকার কথা নয়। কিন্তু এই বিধি উপেক্ষা করে টানা প্রায় ২১ বছর ধরে এক জেলাতেই ঘুরেফিরে দায়িত্ব পালন করেন।

আরও পড়ুন

ছাবিউলের বিষয়টি জেনে গাইবান্ধা সনাকের (টিআইবি পরিচালিত) সদস্য সাখাওয়াৎ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এমনিতেই এক জেলায় দীর্ঘ সময় থাকা বিধিসম্মত হয়নি। তিনি সরকারি বিধি লঙ্ঘন করেছেন। ফলে এক জেলায় ঘুরেফিরে এত দিন থাকার কারণে তিনি সাহসী হয়ে ওঠেন। পরিচিতি বেড়ে যায়। অনিয়ম-দুর্নীতি করার সাহস পান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গাইবান্ধার এক ঠিকাদার বলেন, একই জেলায় দীর্ঘদিন থাকার কারণে ওই প্রকৌশলী নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। বিশেষত ঠিকাদারেরা তাঁর কাছে জিম্মি ছিলেন। ঘুষ ছাড়া ফাইল সই করতেন না।

এলজিইডির তালিকাভুক্ত ঠিকাদার মিলন মিয়া অভিযোগ করেন, ওই নির্বাহী প্রকৌশলী প্রথম বিল সই করার সময় শতকরা ৫ ভাগ এবং চূড়ান্ত বিল সই করতে শতকরা ১০ ভাগ টাকা ঘুষ নিতেন। টাকাসহ ধরা পড়ার ঘটনাটি সঠিকভাবে তদন্ত করলে রহস্য উদ্‌ঘাটন হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ঠিকাদার ও এলজিইডির এক কর্মকর্তা বলেন, ঘুষ নিয়ে বিল ছাড় করা ছাড়াও তিনি সড়ক নির্মাণকাজে নিজেই পাথর, বিটুমিন, ইটের খোয়া ও রড ঠিকাদারদের কাছে সরবরাহ দিতেন।

তবে কোনো ধরনের ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা দাবি করে ছাবিউল ইসলাম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, কাজ ঠিক থাকলে বিল ছাড় করা হয়। কোনো ধরনের ঘুষ নেওয়ার প্রমাণ কেউ দিতে পারবেন না। গাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া টাকার বিষয়ে তিনি বলেন, তাঁর বাবা মারা যাওয়ার পর জমি বিক্রির টাকা তাঁর চাচা দিয়ে গেছেন। সেগুলো তিনি বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছিলেন।

ছাবিউল ইসলামের গাড়ি থেকে জব্দ করা প্রায় ৩৭ লাখ টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। রোববার বিকেলে নাটোরের সিংড়া আমলি আদালতের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার জাহান এ আদেশ দেন। এর আগে এ ঘটনায় করা সাধারণ ডায়েরির (জিডি) তদন্তকারী কর্মকর্তা সিংড়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রাজু আহমেদ জব্দ করা টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়ার নির্দেশ চেয়ে দুপুরে আদালতে আবেদন করেন।

আরও পড়ুন

এর আগে বৃহস্পতিবার রাত দুইটার দিকে নাটোর-বগুড়া মহাসড়কের সদরের চলনবিল গেট এলাকায় তল্লাশির সময় প্রাইভেট কার থেকে এসব টাকা জব্দ করা হয়। শুক্রবার বিকেলে নির্বাহী প্রকৌশলীকে ছেড়ে দেওয়া হয়। প্রাইভেট কারটি সিংড়া থানা হেফাজতে আছে।

জিডির তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই রাজু আহমেদ জানান, টাকাগুলো এলজিইডির কর্মকর্তা জমি বিক্রির টাকা বলে দাবি করলেও এর সমর্থনে কোনো কাগজপত্র জমা দিতে পারেননি। তাই টাকার বৈধতা নিরূপণের জন্য তিনি দুর্নীতি দমন কমিশনে আবেদন পাঠিয়েছেন। তাঁরা তদন্ত করে টাকার উৎস সম্পর্কে প্রতিবেদন দেবেন। প্রতিবেদন পাওয়ার পর পরবর্তী আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

গাইবান্ধা নাগরিক পরিষদের আহ্বায়ক বিশিষ্ট আইনজীবী সিরাজুল ইসলাম বলেন, যে কর্মকর্তা দীর্ঘ সময় ঘুরেফিরে একই জায়গায় থাকেন, তাঁর মধ্যে অসৎ উদ্দেশ্য থাকে।