খুলনায় কৃষি খাতে তারুণ্যের বৈচিত্র্য 

নতুন নতুন উদ্ভাবনী কৌশল আর মেধা কাজে লাগিয়ে যুবকেরা গড়ে তুলছেন ছোট ছোট খামার। আগে চাষ হয়নি, বাজারে চাহিদা ও মূল্য বেশি এমন ফসলের দিকেই ঝোঁক তাঁদের। 

গত বছর শুধু পেয়ারাবাগান থেকেই দেড় লাখ টাকার মতো নিট মুনাফা করেছেন তৌহিদুল ইসলাম। এ বছর পেয়ারাগাছের আকার আরও বড় হয়েছেছবি: সাদ্দাম হোসেন

বিশাল বড় বিলজুড়ে ধানখেত। পাকতে শুরু করেছে ধান। সোনালি আর সবুজের আভা ছড়িয়ে আছে পুরো বিলে। বিলের পাশেই কিছুটা উঁচু জমিতে সারি সারি ড্রাগনগাছ। ফুল-ফল সবই আছে সেই গাছে।

ওই বিলে একসময় লবণপানি তুলে চিংড়ি চাষ করা হতো। এ কারণে লবণাক্ততায় বিলের পাশের জমিগুলোয় কোনো ফসল হতো না। জমিগুলো ছিল পতিত। এমন পড়ে থাকা তিন বিঘা জমিতে ড্রাগন চাষ করে রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছেন তৌহিদুল ইসলাম। ওই এলাকায় ড্রাগনবাগান আর একটিও নেই।

শুধু ড্রাগন লাগিয়েই ক্ষান্ত হননি তৌহিদুল। জমির চারপাশ দিয়ে সাথি ফসল হিসেবে লাগিয়েছেন প্রায় এক হাজার বিভিন্ন জাতের কলাগাছ। সেসব কলাগাছে ফল ধরতে শুরু করেছে। এর বাইরে ৫ বিঘার থাই জাতের একটি পেয়ারাবাগান আছে। পাশাপাশি তৌহিদুল পলিনেট পদ্ধতি ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের সবজির চারা উৎপাদন করে বাজারে স্বল্পমূল্যে বিক্রি করছেন।

তৌহিদুল ইসলামের (২৯) বাড়ি খুলনার পাইকগাছা উপজেলার হরিঢালী ইউনিয়নের হরিদাশকাটি গ্রামে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে তিন বছরের মেডিকেল ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করেছেন। কিন্তু সেদিকে যাননি তৌহিদুল। স্বাধীন পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন কৃষিকে। কমপক্ষে ১০ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে তাঁর এসব কৃষি খামারে। নিজেও হয়েছেন সাবলম্বী। তাঁর হাত ধরেই ওই এলাকায় প্রথম ড্রাগনবাগানের যাত্রা শুরু হয়েছে।

২০২০ সালে কোভিড-১৯–এর প্রভাবই বদলে দিয়েছে তৌহিদুলের জীবন। ওই সময় চুয়াডাঙ্গার বিভিন্ন উপজেলায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। সেখানকার কৃষক উদ্যোক্তাদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। ঝুঁকি নিয়ে কৃষিকেই বেছে নিয়েছেন পেশা হিসেবে। তিন বছর ধরে অন্যের জমি ইজারা নিয়ে এসব খামার গড়ে তুলেছেন তৌহিদুল। প্রথম দিকে শিক্ষিত যুবক হিসেবে কৃষি কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন কটূকথা শুনতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু তিনি আশাহত হননি। তাঁর ব্যতিক্রমধর্মী এসব চাষাবাদ দেখতে এখন বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ এসে ভিড় করছেন তাঁর কাছে। এমন খামার করতে কী কী প্রয়োজন, কীভাবে খামার করা যেতে পারে, সে পরামর্শই নিতে আসেন তাঁরা। 

গত বছর শুধু পেয়ারাবাগান থেকেই দেড় লাখ টাকার মতো নিট মুনাফা করেছেন তৌহিদুল ইসলাম। এ বছর পেয়ারাগাছের আকার আরও বড় হয়েছে। এ কারণে সেখান থেকে ছয় লাখ টাকার মতো নিট মুনাফা হবে বলে আশা করছেন তিনি। পাশাপাশি ড্রাগনবাগান থেকেও কমপক্ষে চার লাখ ও কলা থেকে এক লাখ টাকার মুনাফা হবে তাঁর।

খুলনায় তৌহিদুল ইসলামের মতো এমন শিক্ষিত যুবকেরা চাকরি পেছনে না ছুটে পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছেন কৃষিকে। তাঁরা নতুন নতুন উদ্ভাবনী কৌশল আর মেধা কাজে লাগিয়ে গড়ে তুলছেন ছোট ছোট খামার। আগে চাষ হয়নি, বাজারে চাহিদা ও মূল্য বেশি এমন ফসলের দিকেই ঝোঁক এসব যুবকদের। আর তাতেই মিলছে অর্থনৈতিক মুক্তি। এতে একদিকে যেমন আয় বাড়ছে, তেমনি ফসলেও আসছে বৈচিত্র্য। কেউ গড়ে তুলছেন চুইবাগান, আবার কেউবা মাসরুম। কেউবা সাবলম্বী হচ্ছেন ধানসহ বিভিন্ন সবজির বীজ উৎপাদন করে। শুধু গাছের চারাও উৎপাদন করছেন কেউ কেউ। স্ট্রবেরি, গ্রীষ্মকালীন টমেটো ও শিম, মাল্টা, বারোমাসি তরমুজসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ করছেন তাঁরা। প্রচলিত কৃষি ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে চাষাবাদে মনোযোগী হচ্ছেন এসব যুবকরা। ইউটিউব দেখে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ফসল উৎপাদনের ধারণা নিয়ে তা বাস্তবে প্রয়োগের চেষ্টা করছেন। এসব যুবকদের হাত ধরেই আধুনিক বাণিজ্যিক কৃষিতে পরিণত হচ্ছে খুলনার কৃষি খাত।

এখন শিক্ষিত যুবকেরা কৃষিতে ঝুঁকছেন। এর অন্যতম কারণ তাঁরা চাকরির মাধ্যমে অন্যের ওপর নির্ভরশীল থাকতে চান না, অন্যের পিছু পিছু ঘুরতে চান না। এ জন্য স্বাধীন পেশা হিসেবে কৃষিকেই বেছে নিচ্ছেন। তাঁদের হাত ধরে আধুনিক বাণিজ্যিক কৃষি প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।
মোছাদ্দেক হোসেন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খুলনা অঞ্চলের জ্যেষ্ঠ মনিটরিং অফিসার (পাটনার প্রকল্প)

যুবকদের এভাবে কৃষিতে ঝুঁকে পড়ার ব্যাপারটিকে ভালোভাবেই দেখছে কৃষি অধিদপ্তর। যুগোপযোগী বিভিন্ন পরামর্শ ও বিভিন্নভাবে সহায়তা করে এসব যুবকদের উৎসাহিত করছে সরকারি এ প্রতিষ্ঠানটি। কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, শিক্ষিত যুবকদের হাতে বদলে যাচ্ছে প্রচলিত ধারার কৃষি। এসব যুবকেরা ঝুঁকি নিয়ে মূল্যবান বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি, ফল-মূল চাষ করছেন। স্বল্প সময় ব্যয়ে কৃষিকাজ করেও যে অধিক লাভবান হওয়া যায়, তা যুবকেরা বুঝতে শুরু করেছেন। এ কারণে তাঁরা আর চাকরির পেছনে না ছুটে কৃষিকে পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছেন।

ধান বীজসহ বিভিন্ন ধরনের শষ্যের বীজ উৎপাদন খামার গড়ে তুলেছেন ডুমুরিয়া উপজেলার টিপনা গ্রামের শেখ মনজুর রহমান। ৩৫ বছর বয়সেই ব্যাপক সাফল্য পেয়েছেন। খুলনা বিভাগের বিভিন্ন জেলাসহ ঢাকা ও বরিশাল বিভাগে বীজ সরবরাহ করেন তিনি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরও তাঁর কাছ থেকে বীজ নেয়। 

পড়াশোনার পাশাপাশি কৃষিকাজ দিয়েই পেশা শুরু করেছিলেন মনজুর রহমান। পরে ঝুঁকে পড়েন বীজ উৎপাদনে। এখন তিনি একজন সফল উদ্যোক্তা। মনজুর রহমান বলেন, ‘চাকরির দিকে না গিয়ে কৃষি নিয়ে পড়ে আছি। যাঁরা চাকরি করেন, তাঁদের থেকে অনেক ভালো আছি।’ 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খুলনা অঞ্চলের জ্যেষ্ঠ মনিটরিং অফিসার (পাটনার প্রকল্প) মো. মোছাদ্দেক হোসেন বলেন, ‘এখন শিক্ষিত যুবকেরা কৃষিতে ঝুঁকছেন। এর অন্যতম কারণ তাঁরা চাকরির মাধ্যমে অন্যের ওপর নির্ভরশীল থাকতে চান না, অন্যের পিছু পিছু ঘুরতে চান না। এ জন্য স্বাধীন পেশা হিসেবে কৃষিকেই বেছে নিচ্ছেন। তাঁদের হাত ধরে আধুনিক বাণিজ্যিক কৃষি প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।’