শ্বাসকষ্টে মারা যাওয়া ব্যক্তিকে দেখানো হলো গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত

মামলা
প্রতীকী ছবি

কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানায় গত ২৯ নভেম্বর হওয়া একটি হত্যা মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৭৬৮ জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলাটির এজাহারে তিনটি ভিন্ন ঘটনার কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে দ্বিতীয় ঘটনার বর্ণনায় লেখা হয়েছে, গত ১৮ জুলাই দুপুর ১২টার দিকে জেলা শহরের গৌরাঙ্গ বাজার মোড় এলাকায় ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের নেতা-কর্মী ও তাঁদের দোসররা সাঁড়াশি আক্রমণ করে এবং এলোপাতাড়ি গুলি চালান। এ সময় দুলাল রবিদাস নামের একজন মুচি বুকে গুলি লেগে গুরুতর জখম হন। দুলাল রবিদাসের মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য ২২ থেকে ২৩ জন আসামি তাঁকে রড দিয়ে বেদম পিটুনি দেন। এ সময় কয়েকজন দুলাল রবিদাসকে উদ্ধারের পর দ্রুত কিশোরগঞ্জের ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান।

প্রকৃতপক্ষে দুলাল রবিদাস নামের কেউ সেদিন মারা যাননি। এ নামে যাঁর কথা বলা হয়েছিল, তিনি সেদিন বাজারেও যাননি। এ বিষয়ে দুলাল রবিদাসের ছোট ভাই কাঞ্চন রবিদাস প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার দিন তাঁর ভাই গৌরাঙ্গ বাজার মোড়ে ছিলেন না। তিনি দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসকষ্টজনিত রোগে ভুগছিলেন। তাই আন্দোলন চলাকালীন বেশির ভাগ দিন নিজ বাড়িতেই অবস্থান করেন। মামলায় বর্ণিত ঘটনার পরদিন, অর্থাৎ ১৯ জুলাই শ্বাসকষ্টের কারণে বাড়িতে তিনি মারা যান। কাঞ্চন বলেন, ‘কিন্তু এখন শুনতেছি, আমার বড় ভাই নাকি আন্দোলনের সময় গুলিতে মারা গেছেন। এ ঘটনায় মামলাও হয়েছে। তবে এ মামলার বিষয়ে আমরা পরিবারের কেউ কিছু জানি না। তবে মামলা হওয়ার পর আসামিরাসহ অনেকেই এসে আমাদের এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা এখন দুশ্চিন্তায় আছি।’

মামলাটি করেছিলেন জেলা শহরের মনিপুরঘাট এলাকার জসিম উদ্দিনের ছেলে রাফিউল আলম (২৫)। মামলায় তিনি ১৬৮ জনের নাম উল্লেখ করেছিলেন বলে জানানো হয়। কিন্তু রফিউল ইসলাম প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ‘মামলাটি আমি একা করিনি। আমরা চার-পাঁচজন মিলে পরামর্শ করে করেছি। কিন্তু এখানে আমি ১৩০ জনের নাম দিয়েছিলাম। বাকি ৩৮ জনের নাম কীভাবে ঢুকল, সেটা বুঝতেছি না। এর মধ্যে হিসাব করে দেখেছি, ১৯ জনের মতো নিরীহ লোকসহ বিএনপির লোকজনও ঢুকে গেছে। এখন অনেকে নাকি আমার নাম ভাঙিয়ে আসামিদের ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকাও নিচ্ছে। অথচ এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। এটা নিয়ে আমি নিজেই এখন অনেকটা বেকায়দায় আছি। বুঝতে পারছি না, এখন কী করব?’

তবে এ বিষয়ে কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘মামলায় বাদী আসামিদের যে সংখ্যা দিয়েছে, সেটাই আছে। সব আসামির নাম লেখার পর বাদী স্বাক্ষর করে এজহারের যে কপি দেয়, সেটাই এফআরআই করা হয়। থানার পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো আসামির নাম দেওয়া বা বাদ দেওয়ার কোনো সুযোগ নাই।’

আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর মামলা দেওয়ার মাধ্যমে যে বাণিজ্য ও অন্যকে হয়রানি করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, সেটির একটি উদাহরণ এটি। এমন আরেকটি উদাহরণ এখানে তুলে ধরা হলো।

গত ৯ সেপ্টেম্বর কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানায় হওয়া একটি মামলায় জেলা শহরের শোলাকিয়া এলাকার বাসিন্দা রুহুল আমিন নামের এক যুবদল কর্মীকে আসামি করা হয়। রুহুল আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সরকারের বিরুদ্ধে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ায় একটি মামলায় ১৭ মাস কারাভোগ করেন। এবার এ মামলার আসামি হওয়ার পর তিনি এ বিষয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বরাবর জেলা বিএনপির কিছু নেতার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেন।

এ মামলার বাদী শিক্ষানবিশ আইনজীবী সুজন মিয়া। তিনি বলেন, তিনি রুহুলকে চেনেন না। কীভাবে মামলায় রুহুলের নাম ঢুকেছে, সেটাও জানেন না। শুধু রুহুল নন, এ মামলায় যে ৯০ জনকে আসামি করা হয়েছে, এর মধ্যে বেশির ভাগ আসামিকেই তিনি চেনেন না। এমনকি মামলায় তাঁর নিজের আত্মীয়স্বজনের নামও আসামির তালিকায় এসেছে। এ নিয়ে বাড়িতে তাঁকে অনেক কথা শুনতে হচ্ছে। এ কারণে তিনি নিজেই এখন দৌড়ের ওপর আছেন।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৫ আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত কিশোরগঞ্জে অন্তত ৪২টি রাজনৈতিক মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ৩ হাজার ৫৫৯ জনের নাম উল্লেখ ও ১০ হাজারের বেশি লোককে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২৭০ জনকে। আসামিরা মূলত আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী। এ ছাড়া আসামির তালিকায় জেলার সাত–আটজন সাংবাদিকও আছেন। ছাত্র আন্দোলনের সময়ে কিশোরগঞ্জ জেলায় মোট ৬ জন নিহত ও কয়েক শ লোক আহত হয়েছিলেন।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর কিশোরগঞ্জে হওয়া অনেকগুলো মামলা নিয়েই সমালোচনা চলছে। এসব মামলার ক্ষেত্রে নিয়মনীতি ঠিকভাবে অনুসরণ করা হয়নি বলে অভিযোগ আছে। মামলায় আসামির তালিকায় নাম দেওয়া, না দেওয়া নিয়ে বাণিজ্যের অভিযোগও আছে। এসব ঢালাও মামলা নিয়ে এখন বিএনপিসহ বিভিন্ন মহল থেকে উদ্বেগ ও সমালোচনা করা হচ্ছে।

বিভিন্ন জেলায় গায়েবি মামলার কথা বলেছেন খোদ ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী। রোববার সাংবাদিকদের তিনি বলেছিলেন, ‘ভুয়া মামলা হয়েছে, গায়েবি মামলা হয়েছে, মামলার আসামি ২০০-৩০০। নতুন করে যেটা শুরু হয়েছে, সেটা হলো বাদীরা প্রত্যেকের কাছ থেকে টাকা চাইছে। টাকা দাও, নাম কেটে দেব।’

কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জে দুটি মামলা নিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে তীব্র নিন্দা জানানো হয়েছে। উপজেলা বিএনপির সভাপতি মো. আজিজুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা দুলাল শিকদার স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গত ২৯ নভেম্বর কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানায় এবং ৬ নভেম্বর বাজিতপুর থানায় দুটি মামলা হয়। এসব মামলায় আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের আসামি করা হলেও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে করিমগঞ্জ উপজেলা, পৌরসভা, জয়কা ইউনিয়নসহ বিভিন্ন এলাকায় বিএনপির কিছু নিরীহ মানুষ এবং নেতাদের নাম যুক্ত করা হয়। যাঁরা সক্রিয়ভাবে ১৭ বছর ধরে আন্দোলন–সংগ্রাম করে আসছেন, সম্পত্তি নিয়ে কলহ, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব ও প্রতিহিংসার কারণে এমন নিরপরাধ ব্যক্তিদের এ মামলায় আসামি করা হয়।

জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম বলেন, অহেতুক নিরপরাধ কাউকে যেন মামলায় জড়ানো না হয়, সে বিষয়ে নেতাদের নির্দেশ দেওয়া আছে। তবু অনেকে তাঁদের জিজ্ঞেস না করে মামলা করে দিচ্ছেন। কিছু মামলায় ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে কাউকে কাউকে আসামি করা হচ্ছে। বিষয়গুলো জানার পর আর যেন মামলা না নেওয়া হয়, সে জন্য বিভিন্ন থানার ওসিদেরও বলা হয়েছে। এরপরও অনেকে গিয়ে নিজেদের ফায়দা হাসিলের জন্য থানাসহ আদালতে মামলা করে দিচ্ছেন। বারবার মামলার বিষয়ে নিষেধ করা সত্ত্বেও থামানো যাচ্ছে না। এ কারণে বিষয়টি নিয়ে এখন তাঁরা উদ্বিগ্ন।

পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী বলেন, ৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত কিশোরগঞ্জে ৪২টি মামলা করা হয়েছে। এতে সাড়ে তিন হাজারের মতো এজাহারভুক্ত আসামিসহ আরও অজ্ঞাতনামা কয়েক হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। এসব মামলায় ২৭০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রতিটি মামলার বিষয়ে সঠিক তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।